শান্ত বরিশালে হঠাৎ করে এক ভয়ংকর অপরাধী চক্রের উত্থান ঘটেছে। কতিপয় তরুণ-তরুণীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই চক্রটি অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অভিজাত পরিবারের ছেলেদের টার্গেট করে এবং সুরেলা কণ্ঠের তরুণীদের ব্যবহারের মাধ্যমে যুবকদের মোহিত করে বহুমুখী অনৈতিক প্রলোভনে। অন্ধকার জগতের নোংরা তরুণীদের এই প্রস্তাবে সম্মত হয়ে বরিশালে অসংখ্য যুবক নিজেদের মান-সম্মানসহ অর্থকড়ি হারালেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হওয়ার উদাহরণ খুব কম রয়েছে।
সূত্রের খবর, ভয়ানক এই প্রতারণার নাম ‘হানিট্র্যাপ’, যার আক্ষরিক অর্থ ‘মধুফাঁদ’। সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যায় করলে সুরেলা কণ্ঠের মেয়েদের দিয়ে ‘মধুফাঁদ’ তৈরি করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা মোবাইলে রোমাঞ্চকর অভিব্যক্তিতে যুবকদের মুগ্ধ করে এবং পরবর্তীতে অপরাধ জগতের সদস্যরা যুবকদের বিশেষ স্থানে ডেকে নিয়ে জিম্মি করে ফেলে।
বিভিন্ন মাধ্যম নিশ্চিত করেছে, কীর্তনখোলার তীর জনপদের শহর বরিশালে এই অপরাধে অন্তত অর্ধশত তরুণ-তরুণী ‘হানিট্র্যাপ’ নামক অপরাধে জড়িত রয়েছেন। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ এই অপরাধ চক্রটি সম্পর্কে ইতোমধ্যে ব্যাপক লোমহর্ষক তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে, যা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।‘হানিট্র্যাপ’ চক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে বরিশাল শহরের ধান গবেষণা রোডের জনৈক যুবক কোতয়ালি মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। সেই মামলাটি বিশদ বিবরণে উঠে আসে এই গ্রুপের ভয়ানক প্রতারণার কাহিনি, যা শুনলে অনেকের চোখ কপালে উঠবে। পুলিশ এই মামলার ১২ আসামির মধ্যে দুজন তরুণ-তরুণী পাখি আক্তার নিশি এবং ভুয়া সাংবাদিক রিমনকে রোববার গ্রেপ্তার করেছে।
জানা গেছে, ভুক্তভোগী নাঈমের সঙ্গে পাখি আক্তার নিশির ফেসবুকের একটি গ্রুপে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে মোবাইল নম্বর বিনিময়সহ তরুণীর শ্রুতিমধুর কণ্ঠে তিনি বিমোহিত হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তরুণী তাকে শহরের একটি নিরাপদ স্থানে একা মিলিত হওয়ার প্রস্তাব দেন। এই অনৈতিক ইশারায় যুবক সায় দিয়ে গত ২১ অক্টোবর তাকে বরিশাল নগরীর হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা এলাকার ঈদগাহ লেনের একটি বাসায় নিয়ে যান।
সেখানে অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগ তুলে তাকে জিম্মি করে ফেলে তরুণীর পুরুষ সঙ্গীরা। এবং তাদের মধ্যকার দুজন—রিশাদ এবং সাজিদ—বুম হাতে নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করেন। এতে যুবক নাঈম কিছুটা ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার কাছ থেকে নগদ ৫৩ হাজার টাকাসহ মোবাইল নিয়ে যাওয়া হয়।এই গ্রুপের দুই সদস্য পাখি এবং ভুয়া সাংবাদিক রিমনকে রোববার সাংবাদিকদের সহযোগিতায় গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে কোতয়ালি পুলিশ। সূত্রের খবর হচ্ছে, নাঈমকে যারা হানিট্র্যাপে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়, তাদের পেছনে এক যুবককে লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেই যুবক বোকা চরিত্রের অভিনয় করে রোববার ভাটিখানা এলাকায় নিশির গোপন আস্তানায় পৌঁছে যায়। কিছুক্ষণ পরে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করাসহ ভুয়া সাংবাদিক এবং তরুণী নিশিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে। এই চক্রের বাকি সদস্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বিভিন্ন সূত্র মারফত জানা গেছে, রিমন-নিশির ন্যায় আরও অন্তত ৫-৭টি ‘হানিট্র্যাপ’ চক্র বরিশালে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। গত ২৭ নভেম্বর আরেকটি চক্রের দুই সদস্য—হাসিব রহমান এবং সায়েম সিকদারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। ঘটনার দিন তারা দুজনে শহরের চৌমাথা পুকুরপাড়ে প্রেমিক যুগলের ভিডিও ধারণ করেন এবং পরবর্তীতে এই ভিডিও পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে এক দফা ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় তখন, যখন আরও অর্থ দাবি করা হয়। স্থানীয়রা এই দুই ভুয়া সাংবাদিককে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন।সূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়ার ক’দিন আগে এই দুই যুবক শহরের কলেজ অ্যাভিনিউ রোডের একটি বাসায় হানা দিয়ে ভিডিও করতে থাকেন এবং এই বাসাটিতে অসামাজিক কার্যকলাপ হয় অভিযোগ তুলে লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। পরে তারা দুটি মোবাইল ফোনসহ স্বামী-স্ত্রীর কাছ থেকে নগদ ১৫ হাজার টাকা নিয়ে আসেন।
তবে মাঠ পুলিশের এক কর্মকর্তা বলছেন, এই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে অনেকেই ইজ্জতের ভয়ে পুলিশের কাছে আসতে চাইছেন না। ফলে দিন দিন ‘হানিট্র্যাপ’ নামক অপরাধের আরও বিস্তৃতি ঘটছে। একের পর এক মানুষ নীতিবিবর্জিত তরুণীদের ফাঁদে পড়ে অর্থকড়িও হারাচ্ছেন। এই চক্রটিকে নির্মূল করতে পুলিশ তৎপরতা চালিয়ে আসছে।
কোতয়ালি মডেল থানা পুলিশের আওতাধীন স্টিমারঘাট ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ গোলাম মো. নাসিম রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘মধুফাঁদ’ নিয়ে তিনি কাজ করছেন। ইতোমধ্যে তিনি অন্তত এই চক্রের বিভিন্ন গ্রুপের ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছেন।এই হানিট্র্যাপ গ্রুপে বরিশালের বদনাম হচ্ছে এবং তাদের নীতিবিবর্জিত কার্যকলাপে নাগরিক জীবনে প্রভাব ফেলেছে, তা খোদ সমাজকর্মীরাও স্বীকার করেছেন। সামাজিক সংগঠক ও সিনিয়র সাংবাদিক আনিসুর রহমান স্বপন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই ধরনের অপরাধ রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের নিশ্চুপ না থেকে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করা উচিত।’
প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম গন মাধ্যম কে বলেন, ‘মাঠপুলিশকে হানিট্র্যাপ চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। রাতারাতি দুটি ঘটনায় ইতোমধ্যে ১০ জনের বেশি তরুণ-তরুণীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই চক্রে জড়িত বাকি সদস্যদের টুটি চেপে ধরতেও পুলিশ নিরলস কাজ করছে।’