ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও ব্রিটিশ আইনসভার সদস্য টিউলিপ সিদ্দিককে একটি দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে ২ বছর সাজা ঘোষণা করেছেন ঢাকার একটি আদালত। গতকাল সোমবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক মো. রবিউল আলম তাকে সাজার এ রায় দেন।
রুলে বিচারক জানান, হ্যাম্পস্টেড এবং হাইগেটের লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ হিসেবে বিশেষ প্রভাব খাটিয়ে শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করে তার মা, ভাই ও বোনের জন্য মূল্যবান জমি নিতে সাহায্য করেছেন। এই রায়ে টিউলিপের মা শেখ রেহানাকে সাত বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রভাবশালী কোনো দেশের জনপ্রতিনিধিকে তার পদে থাকাবস্থায় সাজা দেওয়ার এমন ঘটনা নজিরবিহীন। বিষয়টি নিয়ে দেশের পাশাপাশি লন্ডনেও ব্যাপক আলোচনা চলছে।
তবে মামলা হওয়ার পর থেকেই একে সাজানো ও প্রহসনমূলক বলে আসছিলেন ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক। ব্রিটিশ আইনসভার এই সদস্য তার অনুপস্থিতিতে বিচার ও আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তবে তিনি সেই সুযোগ পাননি বলে দাবি করেছেন। এবার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর টিউলিপ সিদ্দিকের আইনসভার সদস্য থাকা বা ব্রিটেনে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
টিউলিপের বিরুদ্ধে দুদকের অভিযোগ, নিজের মাকে প্লট পাইয়ে দিতে তিনি তার বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে খালা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার ওপর চাপ প্রয়োগ ও প্রভাব বিস্তার করেন।
এর আগে যখন টিউলিপের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠজনের দেওয়া প্লট ব্যবহারের অভিযোগ এসেছিল, তখন তাকে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সদস্য পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল।
তবে টিউলিপের সাজার ঘটনায় তার এমপি হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে অসুবিধা হবে না বলেই মনে করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর চিফ সেক্রেটারি ড্যারেন জোন্স। তিনি বলেন, ‘এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি মনে করি, বাংলাদেশে যে বিচার হয়েছে, তিনি (টিউলিপ) সেটার অংশ ছিলেন না। তিনি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু তাকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। এই বিচার যতটা না আইনগত তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করেছে। টিউলিপ ইতিমধ্যেই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটি এমন সিদ্ধান্ত, যা অন্য দেশে হয়েছে এবং বিদেশি একটি আদালত তাকে সাজা দিয়েছে। আমার মনে হয় না এতে নির্বাচনি এলাকার প্রতিনিধি হিসেবে টিউলিপের আইনসভায় প্রতিনিধিত্বটা বাধাগ্রস্ত হবে।’
এ ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই, তাই টিউলিপের এই সাজা ভোগ করার সম্ভাবনা কম। লেবার পার্টি এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির এই রায়কে স্বীকৃতি দেয় না, কারণ তাকে এই মামলায় সুষ্ঠু আইনি প্রক্রিয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
তবে টিউলিপের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়নি, সেই বিষয়ে গতকাল বিচারক রায় প্রদানকালে ব্যাখ্যা দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ- হয়Ñ এমন কোনো ধারার অভিযোগ না থাকায় আসামিদের জন্য ডিফেন্স ল’ইয়ার নিয়োগ প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। উচ্চ আদালতে একাধিক সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে আদালতের শুনানির অধিকার দাবি করার আগে সংশ্লিষ্ট আসামিকে আগে বিচার প্রক্রিয়ায় নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে হয় এবং পরে বিচার দাবি করতে হয়। অন্যথায় আসামি বিচারিক সুবিধা পেতে পারে না। তবে টিউলিপ প্রথম থেকেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেছিলেন, এই সমস্ত অভিযোগের মূলে রয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব।
রাজধানীর পূর্বাচলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে হওয়া এই মামলায় টিউলিপ ছাড়াও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৫ বছর ও টিউলিপের মা শেখ রেহানাকে ৭ বছর কারাদ- দেওয়া হয়েছে। তাদের ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২)/পেনাল কোডের ১০৯ ধারায় এই সাজা দেওয়া হয়। আসামিদের এক লাখ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদ- দেন আদালত।
মামলার আরও ১৪ জন আসামিকে ৫ বছর করে কারাদ- ও এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের সাজা দেওয়া হয়। আসামিদের মধ্যে শুধু রাজউকের সাবেক সদস্য (স্টেট ও ভূমি) খুরশীদ আলম বিচার চলাকালে আত্মসমর্পণ করেন। শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকসহ বাকি আসামিরা পলাতক। পলাতক আসামিদের কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
সাজাপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম সরকার, সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, অতিরিক্ত সচিব অলিউল্লাহ, সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানের পিএ মো. আনিছুর রহমান মিঞা, সাবেক সদস্য মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, তন্ময় দাস, মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, মেজর (ইঞ্জি.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (অব.), সাবেক পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক মাজহারুল ইসলাম, উপপরিচালক নায়েব আলী শরীফ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন এবং সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ।
গত ২৫ নভেম্বর মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দিন ধার্য ছিল। সেদিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বিচারক রায়ের জন্য আজকের দিন ধার্য করেন আদালত।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, শেখ রেহানার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি মামলা দায়ের করেন দুদকের উপপরিচালক সালাহউদ্দিন। তদন্ত শেষে গত ১০ মার্চ ১৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া।
গত ৩১ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। বিচার চলাকালে এই মামলায় ৩২ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।
প্লট বরাদ্দের দুর্নীতির অভিযোগে গত জানুয়ারিতে পৃথক ৬ মামলা করে দুদক। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল), বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে ও ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও অপর মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকসহ আরও অনেককে আসামি করা হয়। সব মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা সরকারের সর্বোচ্চ পদে থাকাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ওপর অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। তারা বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নং রাস্তার ৬টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
‘ক্যাঙ্গারু আদালতের প্রহসনমূলক বিচার’-গার্ডিয়ানকে টিউলিপ
এদিকে প্লট দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশের আদালতের দেওয়া রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিক বলেছেন, পুরো প্রক্রিয়াটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও প্রহসনমূলক। গতকাল রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে এ কথা বলেন তিনি।
টিউলিপ বলেন, পুরো প্রক্রিয়াটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল ত্রুটিপূর্ণ ও প্রহসনমূলক। তিনি বলেন, এই ক্যাঙ্গারু আদালতের ফলাফল যেমন অনুমানযোগ্য, তেমনি অযৌক্তিক। আমি আশা করি এই তথাকথিত রায় যে অবজ্ঞা পাওয়ার যোগ্য, তা পাবে। আমার মনোযোগ সব সময় আমার হ্যাম্পস্টেড এবং হাইগেটের ভোটারদের প্রতি। আমি বাংলাদেশের এই নোংরা রাজনীতি দ্বারা মনোযোগ হারাতে চাই না।