আমরা সবাই আজকাল কমবেশি টিভি দেখে থাকি। স্মার্ট ফোনের সহজলভ্যতার কারণে এখন টেলিভিশন দেখার প্রবণতা কমে গেলেও এখন ও অনেকে দেখে থাকি। খেয়াল করে দেখবেন আপনি যখন আপনার টিভি চ্যানেল পরিবর্তন করেন, তখন স্ক্রিনে ছোট ছোট সাদা ও কালো বিন্দু ঝলমল করে। এটি আমরা সাধারণত স্ট্যাটিক বা স্নো নামে জানি। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে অনেকেই এটিকে কেবল বিরক্তিকর বা অসংলগ্ন কিছু মনে করেন। কিন্তু এর মধ্যে লুকানো রয়েছে একটি অত্যন্ত রহস্যময় এবং বিজ্ঞানসম্মত সত্য। বাস্তবে, এই টিভি স্ট্যাটিকের এক ছোট অংশের উৎস হলো মহাবিশ্বের জন্মের সময়কার আলোকিত স্মৃতি, যা আমরা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা CMB নামে চিনি। এটি বিগ ব্যাং-এর পর থেকে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সেই তাপময় রশ্মি, যা আজও সর্বত্র বিদ্যমান। এই ব্যাকগ্রাউন্ড আলোর বর্ধিত পরিমাণ খুবই কম, কিন্তু সঠিকভাবে দেখা যায়, বিশেষ করে যখন টিভি কোনও নির্দিষ্ট চ্যানেলে না থাকে এবং একটি আনটিউনড অবস্থায় থাকে।কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মধ্যে একটি। এটি প্রমাণ করে যে মহাবিশ্বের একটি নির্দিষ্ট শুরু ছিল, যা আমরা বিগ ব্যাং নামে জানি। প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্ব এক অসীম ঘন ও উত্তপ্ত অবস্থায় ছিল। এরপর তা সম্প্রসারণ শুরু করে এবং ঠান্ডা হতে শুরু করে। প্রায় তিন লাখ বছর পর, যখন মহাবিশ্ব যথেষ্ট শীতল হয়ে যায়, তখন আলোর রশ্মি অবাধে চলাচল করতে পারে। সেই সময়ের আলোর রশ্মিই আজও মহাবিশ্বের সমস্ত দিকে ছড়িয়ে আছে। বিজ্ঞানীরা সেটিকে মাপার জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে, যা আমাদেরকে মহাবিশ্বের বয়স, রচনার উপাদান এবং প্রথম সময়ের তাপমাত্রা সম্পর্কে তথ্য দেয়।
আমরা যেভাবে টিভিতে স্ট্যাটিক দেখি, তার পেছনে কাজ করছে অনেকে ধরণের তাপময় ও বৈদ্যুতিক রশ্মি। একটি আনটিউনড টিভি রিসিভার চারপাশের সমস্ত ফ্রিকোয়েন্সি গ্রহণ করে। এই সময় স্ক্রিনে ছোট ছোট ধূসর বা সাদা বিন্দু দেখা দেয়। মূলত এটি আসে স্থানীয় বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট শব্দ, পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে নির্গত তাপীয় রশ্মি, সূর্য ও আকাশের কিছু বিকিরণ এবং কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড। তবে কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের অবদান তুলনামূলকভাবে খুবই কম। পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় ৩০০ কেলভিন, যেখানে কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের তাপমাত্রা মাত্র প্রায় ২.৭ কেলভিন। এই তুলনামূলক ক্ষুদ্রতা বোঝায় যে, টিভির স্ট্যাটিকের মধ্যে কেবল এক শতাংশের বেশি নয় আসল CMB-এর অংশ।
কেন এটি এত ছোট, তা সহজভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। যেহেতু স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী উৎস থেকে আসা রশ্মি অনেক বেশি শক্তিশালী, তাই সেগুলোর ছায়ায় কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের অংশ কম দৃশ্যমান হয়। কিন্তু সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, টিভির এই ছোট অংশের স্ট্যাটিক আসলে মহাবিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন আলোর অবশিষ্টাংশ। এটি একটি চমকপ্রদ ধারণা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ একটি দৃশ্যকে মহাবিশ্বের সাথে সংযুক্ত করে।প্রাচীন CRT টিভি এবং রাবিট-ইয়ার অ্যান্টেনা ব্যবহার করার সময় এই ঘটনা সবচেয়ে সহজে দেখা যেত। আজকের ডিজিটাল টেলিভিশন, কেবল ও স্ট্রিমিং সেবাগুলোতে এটি আর দেখা যায় না। কিন্তু ডিজিটাল টিভিতে বিষয়টা ভিন্ন। ডিজিটাল টিভি সিগন্যাল অনেক বেশি নির্দিষ্ট এবং সঠিক তথ্য বহন করে। রিসিভার বা ডিকোডার সঠিকভাবে সিগন্যাল পায় কি না তা চেক করে। যদি সিগন্যাল ঠিক থাকে, ছবি চলে; যদি সিগন্যাল না মিলে তখন টিভি ব্ল্যাঙ্ক বা No Signal দেখায়। অর্থাৎ, ডিজিটাল টিভিতে তখন স্ট্যাটিক বা স্নো দেখা যায় না, কারণ টিভি মজা বা ভুলভাবে সব সিগন্যাল দেখাচ্ছে না।
ফলে, এই ছোট অংশের কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার থেকে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। তবে বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে তৈরি যন্ত্র ব্যবহার করে এখনও এটিকে মাপতে এবং বিশ্লেষণ করতে পারেন। পেনজিয়াস ও উইলসনের ১৯৬৪ সালের প্রাথমিক আবিষ্কারেই এই ব্যাকগ্রাউন্ড প্রথম সনাক্ত করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে বিগ ব্যাং এর মূল প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের আবিষ্কার মহাবিশ্ববিদ্যায় একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে মহাবিশ্ব কেবল সম্প্রসারিতই হচ্ছে না, বরং এর শুরুও নির্দিষ্ট সময়ে ঘটেছিল। CMB-এর মধ্যে ছোট ছোট অ্যানিসোট্রপি বা তাপমাত্রার ভিন্নতা আমাদেরকে মহাবিশ্বের গঠন, নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির উৎপত্তি এবং অন্ধকার পদার্থের উপস্থিতি বোঝাতে সাহায্য করে। তবে প্রতিদিনের টিভি স্ট্যাটিকে এটি একটি মাইক্রোস্কোপিক এবং প্রায় অব্যবহৃত অংশ হিসেবে থাকে, যা সরাসরি চোখে বোঝা যায় না।
অনেক বিজ্ঞান ও গণমাধ্যম প্রবন্ধে বলা হয়, প্রায় ১% টিভির স্ট্যাটিক আসলে CMB। এটি একটি আনুমানিক সংখ্যা। বাস্তবে এটি নির্ভর করে টিভির অ্যান্টেনা, তার অবস্থান, স্থানীয় ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি এবং পার্শ্ববর্তী সম্প্রচারকের উপর। খুব উচ্চ গুণমানের অ্যান্টেনা এবং নীরব পরিবেশে এই অনুপাত বৃদ্ধি পেতে পারে, আবার শহুরে বা ব্যস্ত এলাকায় এটি কমে যেতে পারে। তাই এই সংখ্যা একটি সাধারণ নির্দেশক মাত্র এবং বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি মজার এবং শিক্ষণীয় উদাহরণ।
আমরা যখন টিভি চালাই এবং স্ট্যাটিক দেখি, তখন আমরা প্রকৃতপক্ষে সেই প্রাচীন আলোর সঙ্গে সংযোগে আসি, যা প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্বে মুক্ত হয়েছিল। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে মহাবিশ্বের ইতিহাসকে সংযুক্ত করে এবং আমাদের অস্তিত্বের সাথে তার গভীর সম্পর্ক বোঝায়। প্রতিটি ছোট বিন্দু, প্রতিটি ঝলমল আসলে এক দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।
অবশেষে বলা যায়, টিভির স্ট্যাটিক কেবল একটি প্রযুক্তিগত বা দৈনন্দিন ঘটনার অংশ নয়। এটি আমাদের মহাবিশ্বের ইতিহাসের একটি সূক্ষ্ম অংশ। যদিও এটি একটি খুব ছোট অংশ, তবে এটি আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে আমরা এই বিস্তীর্ণ মহাবিশ্বের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত। আমাদের শরীরের হাইড্রোজেন, পৃথিবীর পদার্থ এবং এই ছোট্ট টিভি স্ট্যাটিকের মধ্যে একটি অদৃশ্য সংযোগ রয়েছে। এটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের মধ্যে মহাবিশ্বের অব্যক্ত মহিমা উপলব্ধি করায়।
আমরা যদি টিভির স্ট্যাটিকের প্রতি আরও মনোযোগ দেই, তবে সেটি আমাদেরকে কেবল বিনোদন দেয় না, বরং মহাবিশ্বের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিস্ময়কর উপলব্ধি করায়। এটি একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ যে, বিজ্ঞান শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় নয়; এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে। ছোট একটি টিভি স্ক্রিনের স্ট্যাটিকও আমাদেরকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি, তার তাপমাত্রা এবং ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারে।