রূপগঞ্জে ঘরে ঘরে জ্বরে আক্রান্ত, জনমনে আতঙ্ক \ মশক নিধনে নেই কোনো ব্যবস্থা।
রূপগঞ্জে ডেঙ্গু আতঙ্ক!/করোনার মাঝে আরেক আতঙ্ক ডেঙ্গু/ ডেঙ্গু আতঙ্কে দিশেহারা রূপগঞ্জবাসী।
নারায়ণ সরকার, রূপগঞ্জঃ
ডেঙ্গু আতঙ্কে দিশেহারা রূপগঞ্জের মানুষ। গত এক মাস ধরে ঘরে ঘরে জ্বর আক্রান্ত দেখা দেওয়ায় ডেঙ্গু নিয়ে তোলপাড় চলছে। এ নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। পরিবারের কারো শরীরে জ্বর অনুভব হলেই সবাই আঁতকে উঠছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার কোনো খবর না পাওয়া গেলেও উপজেলার একমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি হবার খবর রয়েছে। ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ এডিস মশা হলেও কার্যত মশক নিধনের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এ উপজেলায়। সরকারী উদ্যোগে এখনো পর্যন্ত নেওয়া হয়নি কোনো সচেতনতা কার্যক্রম। তবে রূপগঞ্জ প্রেসক্লাব, আলরাফী হাসপাতাল, হাজী এখলাসউদ্দিন হাই স্কুল এন্ড কলেজ ও ব্রাইট শিশু কানন হাই স্কুলের উদ্যোগে ইতোমধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেঙ্গু চিন্তায় রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার লোকজনের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আবার অনেকে এ নামের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হয়েছেন। যারা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে তারা এটাকে টাইফয়েড জ্বর হিসেবে ভেবে নিয়েছে। আর যারা এ রোগের ব্যাপারে অবগত রয়েছেন তারাও খুব চিন্তায় রয়েছেন। পরিবারের কারো শরীরে সামান্যতম জ্বর দেখা দিলেই সবাই আঁতকে উঠছেন।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও মেডিকেল ফার্মেসীগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হঠাৎ করেই রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ভাইরাস জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে জ্বরের রোগীর প্রচন্ড ভীড় বাড়ছে। তবে এখনো পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান মেলেনি বলে হাসপাতালগুলোর সূত্রে জানা গেছে। হাসপাতালগুলোর তথ্যমতে, গত এক মাসে রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত জ্বরের রোগী ভীড় করছে। এদের কেউ এক সপ্তাহ, কেউ ৫ দিন, কেউ ৩ দিন, কেউবা দুইদিন ধরে জ্বরে ভুগছে। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৫ জন করে জ্বরের রোগী ভর্তি হচ্ছে। সে হিসেবে উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ১২ টি বেসরকারী হাসপাতালে প্রায় ২শ’ রোগী ভর্তি হয়। এছাড়া পাড়া-মহল্লায় ফার্মেসীগুলোতে জ্বরের রোগীদের প্রতিদিন ভীড় জমে।
এদিকে, এডিস মশার কারণে ডেঙ্গু রোগ ছড়িয়ে পড়লেও সরকারী উদ্যোগে মশক নিধনে আজ অবধি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নেওয়া হয়নি সচেতনতামূলক কোনো কর্মসূচী। বেসরকারীভাবে রূপগঞ্জ প্রেসক্লাব, আলরাফি হাসপাতাল, হাজী এখলাসউদ্দিন স্কুল এন্ড কলেজ ও ব্রাইট শিশু কানন হাই স্কুলের উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় ও স্কুলে-স্কুলে সচেতনতামূলক কর্মসূচী পালন করা হচ্ছে। চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু মূল উপসর্গ হলো জ্বর, মাথা ব্যথা, বুমি হওয়া এবং অস্থিসন্ধির ব্যথা। চোখ লাল হয়ে যাওয়া। জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে পায়ের গোড়ালি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জয়েন্টে প্রচন্ড ব্যথা হয়। এ ক্ষেত্রে মাংসপেশীতে তেমন ব্যথা থাকে না।
গত বুধবার সকালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কথা হয় জ্বরে আক্রান্ত ছয় বছর বয়সী স্কুল পড়–য়া সৌরভ মিয়ার মা ভক্তবাড়ি থেকে আসা রাহিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার ছেলে গত ১৫ দিন ধরে জ্বরে ভুগতেছে। প্রথমে এলাকার ডাক্তার দেখিয়েছে। কিন্তু কাজ না হওয়ায় ৬ দিন আগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছে। ডেঙ্গুর ভয়ে সে তার ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। তিনি বলেন, টিভির খবরে হুনছি ডেঙ্গু জ্বর নাকি অয় এহন। হের লেইগ্যা ডরে ( ভয়ে ) হাসপাতাল আনছি। আমাগো দিকেতো ঘরে ঘরে জ্বর। মানুষ ডেঙ্গু নাম হুইনাই ডরায়। শাহাপুর এলাকার ষাটোর্ধ্ব জয়নব বেগম। গত ৫ দিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত। ডেঙ্গুর ভয়ে হাসপাতাল এসে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু হয়েছে কি-না জিজ্ঞেস করতেই বলেন, এতহানি ডাঙ্গর ( বড় ) অইছি এমুন নাম জীবনে হুনি নাই। যহন জ্বর অইলো বাড়ির লগের মাইনষে কইলো ডেঙ্গু না টেঙ্গু..কি জানি। ধত্তুরি মনে করতে পারতাছি না। হেই ডরে হাসপাতাল ভর্তি অইছি। আর নাইলে কেডায় হাসপাতাল আয়ে। জীবনে কতো জ্বর অইলো। কোনদিনতো হাসপাতাল আহি নাই। পোড়াবো থেকে এসছেন আট মাসের সাফফান। গত কয়েকদিন ধরে সে জ্বরে ভুগছে। সাফফানের মা শরমী সুলতানা বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই ও জ্বরে ভুগছে। প্রথমে টেনশন করিনি। যখন দেখলাম জ্বর ছাড়ছেনা তখন বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি করাই। কারণ সারাদেশে এখন ডেঙ্গু জ্বরের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাই মনে ভয় দেখা দিয়েছে। নামটাই বিদঘুটে। তাই ভয়। ব্রাইট শিশু কানন হাই স্কুলের পরিচালক অ্যাডভোকেট রায়হানা সুলতানা কণা বলেন, জ্বরের কারণে স্কুলে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি কমে গেছে। যদিও ডেঙ্গু জ্বরের রোগী এখনো পাওয়া যায়নি। তারপরও এ নিয়ে সকল অভিভাবকের মধ্যে একপ্রকার আতঙ্কের ছাঁপ রয়েছে। আমরা আশপাশের বিভিন্ন স্কুলগুলোতে সচেতনতা বাড়াতে ইতিমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি।
আলরাফি হাসপাতালের চেয়ারম্যান, রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি ও কলামিষ্ট মীর আব্দুল আলীম বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। তবে আতঙ্ক আছে। আতঙ্ক মানুষের মন থেকে সচেতনতার মাধ্যমে সরাতে হবে। ইতোমধ্যে রূপগঞ্জ প্রেসক্লাব ও আলরাফী হাসপাতালের উদ্যোগে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করেছে। শীঘ্রই গোটা উপজেলায় ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচী পালন করা হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ ফয়সাল আহমেদ বলেন, আমরা এখনো পর্যন্ত ডেঙ্গুয় আক্রান্তের খবর পাইনি। তবে প্রতিদিন অনেক জ্বরে আক্রান্ত রোগী আসে। তবুও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন সচেতনতা বাড়ানো। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ নুর জাহান আরা খাতুন বলেন, জনসচেতনা তৈরি করতে আমরা সেমিনার করেছি। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে স্টিকার, ব্যানার, ফেস্টুন লাগাচ্ছি। আসলে ডেঙ্গু নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। এটা একটা আতঙ্ক ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও এ উপজেলায় এখনো এ রোগীর সন্ধান মেলেনি। তবুও সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। মশার বিস্তার ধ্বংস করতে হবে। নারায়ণগঞ্জ-১ ( রূপগঞ্জ ) আসনের সংসদ সদস্য এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর ( বীরপ্রতিক ) বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। তবে মশার বংশ বিস্তার ধ্বংস করতে হবে। গাজী গ্রুপের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফগার মেশিনের মাধ্যমে ওষুধ ছিটানো হয়। পৌর এলাকাগুলোতে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।