আমাদের সবারই কমবেশি জীবনে একাধিকবার ফোড়ার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিশেষ করে নিতম্বে হলে তো কথাই নেই। এই ফোড়ার ব্যথায় কয়েকদিন ঠিকমতো বসাই যেন হারাম হয়ে যায়। চলুন আজকে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক ফোড়া আসলে কী, কেনোই বা হয়, এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী এবং এর ফলে কী কী স্বাস্থ্যগত জটিলতা হতে পারে।
ফোড়া (Boil বা Furuncle) হলো ত্বকের ভেতরে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলে তৈরি হওয়া বেদনাদায়ক একধরনের গাঁট। সাধারণত Staphylococcus aureus ব্যাকটেরিয়া কিংবা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া ত্বকে প্রবেশ করলে এই সমস্যা হয়ে থাকে। সাধারণত শরীরের নোংরা বা অপরিচ্ছন্ন অংশে ফোড়া বেশি দেখা যায়, তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলেও যেকোনো মানুষের কমবেশি এটি হতে পারে।
ফোড়া হলে সাধারণত ত্বকের নিচে পুঁজ জমে ফুলে ওঠে। এটি সাধারণত লাল, ব্যথাযুক্ত এবং সামান্য গরম অনুভূত হয়। ফোড়া যে কারো হতে পারে এবং শরীরের প্রায় যেকোনো অংশেই দেখা দিতে পারে যেমন মুখ, ঘাড়, পিঠ, হাত, পা, আন্ডারআর্ম, উরু, নিতম্ব এমনকি সংবেদনশীল অঞ্চলগুলোতেও হয়ে অস্বস্তির কারণ সৃষ্টি করতে পারে। এটি এমনকি দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও ব্যাহত করে, বিশেষ করে হাঁটা-চলা, বসা বা পোশাক পরা পর্যন্ত কঠিন করে তুলতে পারে।
ফোড়া সাধারণত বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ হলো:
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ: ত্বকে ক্ষুদ্র ছিদ্র বা কোথাও কেটে গেলে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে ফোড়া সৃষ্টি করতে পারে।
হাইজিন মেইনটেইন না করা: ত্বক ঠিকমতো পরিষ্কার না থাকলে ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি হয়ে ফোড়া সৃষ্টি হতে পারে।
দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা: শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ঘাম ও আর্দ্রতা: বেশি ঘাম বা আর্দ্র পরিবেশে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি সহজ হয়।
চর্মরোগ বা ডায়াবেটিস: বিভিন্ন চর্মরোগের উপসর্গ হিসেবে কিংবা ডায়বেটিস থাকলে ঘন ঘন ফোড়া হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
ফোড়া সাধারণত একাই ঠিক হয়ে যায় তবে ক্ষেত্রবিশেষে ফোড়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। নিচে সংক্ষেপে কিছু পয়েন্ট বলা হলো:
সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া: ফোড়া যদি নিজে নিজে ফেটে যায় এবং সঠিকভাবে পরিষ্কার না করা হয়, তবে ব্যাকটেরিয়া আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে নতুন ফোড়া তৈরি করতে পারে।
অভ্যন্তরীণ ফোড়া: সংক্রমণ ত্বকের গভীরে ছড়ালে তা ত্বকের গভীরে সংক্রমণ করতে পারে, যা অনেক বেশি বিপজ্জনক।
ফিস্তুলা তৈরি: দীর্ঘদিনের ফোড়া ঠিক না হলে ফিস্তুলা হয়ে যেতে পারে, যা পরবর্তীতে অপারেশন ছাড়া নিরাময় করা কঠিন হয়ে যায়।
রক্তে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ: ক্ষেত্রবিশেষে ফোড়া ফেটে গেলে ব্যাকটেরিয়া রক্তে মিশে যেতে পারে, যা রক্তে ইনফেকশন তৈরি করতে পারে।
পুনরাবৃত্তি হওয়া: শরীরে বারবার ফোড়া হলে এটি শরীরের স্বাস্থ্যগত অন্য সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে, যেমন ডায়াবেটিস বা ইমিউন সিস্টেম দুর্বলতা।এছাড়াও আমাদের সবার ভেতরে প্রবণতা আছে ফোড়া ফাটানোর, কিন্তু এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ জোর করে ফাটালে ভেতরের পুঁজের সঙ্গে থাকা ব্যাকটেরিয়া আশেপাশের ত্বকে ছড়িয়ে পড়ে এবং নতুন ফোড়া তৈরি করতে পারে। ফোড়ার পুঁজ আসলে মৃত শ্বেত রক্তকণিকা, ব্যাকটেরিয়া, ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু ও বিভিন্ন প্রোটিনের মিশ্রণ, যা শরীরের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ফল। তাই পুঁজ যতক্ষণ না স্বাভাবিকভাবে বা চিকিৎসকের মাধ্যমে সঠিকভাবে বের হচ্ছে, ততক্ষণ ফোড়ায় চাপ দিলে ব্যাকটেরিয়া ত্বকের গভীরে চলে গিয়ে আরও বড় সংক্রমণ বা রক্তে সংক্রমণ ছড়ানোর মতো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
শুধু তাই নয়, ফোড়া ফাটালে তা ব্যথা বাড়াতে পারে, ক্ষত গভীর হতে পারে এবং স্থায়ী দাগ থেকে যেতে পারে। আবার একটি ফোড়া থেকে আরও ফোড়া হতে পারে ফোড়া ফাটালে। এজন্য ফোড়াকে কখনো নিজেরা ফাটানো উচিত নয়।
দ্রুত ফোড়া থেকে পরিত্রাণ পেতে কিছু পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে:
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা: নিয়মিত হাত ধোয়া এবং ত্বক পরিষ্কার রাখা।
আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ: ঘাম বেশি হলে ত্বক শুকিয়ে রাখা। প্রয়োজনে পাউডার ব্যবহার করা।
ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ভাগ না করা: তোয়ালে, কাপড় বা শেভিং কিট ভাগ না করা। এতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে।
গরম সেঁক ব্যবহার করা: দিনে ২ থেকে ৩ বার গরম সেঁক দিলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, ফোড়া দ্রুত নরম হয়ে পুঁজ বের হতে সাহায্য করে এবং ব্যথাও কমে।
ফোড়া চেপে বা ফাটিয়ে না ফেলা: ফোড়া ফাটিয়ে ফেললে এর ভেতরে থাকা ব্যাকটেরিয়া পুনরায় সংক্রমণ ঘটিয়ে আরও খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া: যদি ফোড়ার আকার ৫ সেন্টিমিটারের বেশি হয়, ব্যথা বাড়তে থাকে, জ্বর আসে, বা ফোড়াটি সংবেদনশীল স্থানে (যেমন মুখ বা মলদ্বার) হয়, তবে দেরি না করে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পুঁজ নিষ্কাশন বা অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া উচিত।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও যথেষ্ট ঘুম: অনেক সময় ঠিকমতো না ঘুমালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং এর ফলে ফোড়া নিয়মিত উঠতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন খাবারের ফলে ফোড়া হতে পারে। তাই স্বাস্থ্যকর খাবার ও যথেষ্ট ঘুম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে খুবই প্রয়োজন।
সুতরাং ফোড়া দেখতে ছোট সমস্যা মনে হলেও এর ব্যথা, অস্বস্তি এবং সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। এটি শরীরের যেকোনো জায়গায় হতে পারে এবং অনেক সময় দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বড় বিরক্তি তৈরি করে। তবে ত্বকের সঠিক যত্ন, পরিচ্ছন্নতা ও সময়মতো চিকিৎসা নিলে ফোড়া সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিজের শরীরের পরিবর্তন বুঝে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সচেতনতা।
তথ্য সূত্র: আমেরিকান একাডেমি অফ ডার্মাটোলজি