রাতের আকাশের দিকে তাকালে আমরা দেখি অগণিত তারকা, অসীম মহাকাশ আর অজানা সব রহস্য। মানুষের কৌতূহলও ঠিক সেই মহাকাশের মতোই বিস্তৃত। এই কৌতূহল থেকেই বহুদিন ধরে একটি প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে যে, মানুষ কি কখনো এমন এক শক্তির উৎস খুঁজে পাবে যেখানে কোনো ইনপুট ছাড়াই অনন্ত শক্তি পাওয়া যাবে? এই ধারণাকেই সাধারণ ভাষায় বলা হয় ফ্রি এনার্জি।
কিন্তু বিজ্ঞান কী বলে? প্রকৃতি কি সত্যিই আমাদের এমন কোনো সীমাহীন শক্তির সন্ধান দিতে পারবে নাকি এটি কেবল মিথ, ভুল বোঝাবুঝি ও অপরিণত বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী ভুল ধারণা? এই প্রবন্ধে আমরা সেই প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক সত্যতা নিয়ে স্পষ্ট, প্রমাণ-ভিত্তিক, সহজ ভাষায় আলোচনা করব।
মানুষের ইতিহাসে শক্তির ধারণা সবসময়ই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করে বাষ্প ইঞ্জিন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পারমাণবিক শক্তি কিংবা সৌর শক্তি প্রতিটি ধাপই আমাদের সভ্যতাকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। তবে শক্তির পিছনে মানুষের অসীম পিপাসাই জন্ম দিয়েছে ফ্রি এনার্জি ধারণার ভুল ব্যাখ্যা। অনেকেই মনে করেন, এমন কিছু যন্ত্র আছে নাকি যা নিজের থেকেই চলতে পারে এবং প্রায় সীমাহীন শক্তি উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে প্রকৃতির নিয়ম দেখলে আমরা বুঝতে পারি, এমন ধারণা শুধু অসম্ভবই নয়, মূলত বিজ্ঞানের মূল ভিত্তির সঙ্গেই সাংঘর্ষিক।
প্রথমেই যা বোঝা দরকার, তা হলো শক্তির মৌলিক নিয়ম। পদার্থবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুযায়ী শক্তি কখনো সৃষ্টি হয় না, কখনো নষ্টও হয় না। এটি কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। এর মানে, কোনো যন্ত্র যদি দাবি করে যে এটি নিজের চেয়ে বেশি শক্তি তৈরি করতে পারে, তাহলে সেটি প্রকৃত অর্থেই প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করছে। আর দ্বিতীয় সূত্র বা এন্ট্রপি থেকে জানা যায়, শক্তি রূপান্তরের প্রতিটি ধাপেই কিছু শক্তি নষ্ট হয়। সুতরাং শতভাগ দক্ষতা তো দূরের কথা, শতভাগের বেশি দক্ষতা অর্জন তো একেবারেই অসম্ভব।এখান থেকেই পারপেচুয়াল মোশন মেশিন নামের ভ্রান্ত ধারণার জন্ম। ইতিহাসে হাজার হাজার উদ্ভাবক দাবি করেছেন যে তারা এমন যন্ত্র তৈরি করেছেন যা থামবে না, শক্তি ক্ষয় হবে না, আর বাইরে থেকে কোনো শক্তি লাগবে না। কিন্তু এসব দাবির কোনোটি কখনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় টিকে থাকতে পারেনি। প্রতিবারই দেখা গেছে হয় মাপজোখে ভুল আছে, নয়তো যন্ত্রে কোনো না কোনোভাবে শক্তি ঢুকছে। বিজ্ঞানের নিয়ম এত সহজে ছলনা সহ্য করে না।
বিজ্ঞানীরা অবশ্যই ফ্রি এনার্জি শব্দটি ব্যবহার করেন, কিন্তু এর অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা। রসায়ন ও তাপগতিবিজ্ঞানে ফ্রি এনার্জি বলতে বোঝানো হয় Gibbs Free Energy যা দিয়ে বোঝা যায় কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটবে কিনা। এটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ধারণা, যার সঙ্গে যাদুকরী শক্তি উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো ব্যাটারি কীভাবে কাজ করবে, কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া কতটা শক্তি দেবে এসবই গণনা করা হয় এই ফ্রি এনার্জি দিয়ে। তাই এখানে ফ্রি শব্দটি কখনোই সীমাহীন শক্তির উৎস বোঝায় না।
বিজ্ঞান জগতে আরেকটি শব্দ প্রায়ই আলোচিত হয় যেটা জিরো-পয়েন্ট এনার্জি বা কোয়ান্টাম ভ্যাকুয়াম এনার্জি নামে পরিচিত। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী মহাকাশের শূন্যস্থানও আসলে পুরোপুরি শূন্য নয়। সেখানে ক্ষুদ্র কণার ওঠানামা হয়, যা শক্তির ক্ষুদ্রতম রূপ তৈরি করে। এটিকে বাস্তবেও পরিমাপ করা গেছে, যেমন Casimir Effect এর মাধ্যমে। তবে এই শক্তি এত ক্ষুদ্র এবং এত সীমাবদ্ধ অবস্থায় থাকে যে এটিকে ব্যবহার করে শক্তিকেন্দ্র তৈরি করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। বহু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বলে যে সরকার নাকি এই প্রযুক্তি লুকিয়ে রেখেছে, কিন্তু বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এগুলো কেবল ভ্রান্তধারণা। এখন পর্যন্ত কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা প্রমাণ করতে পারেনি যে এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে বড় পরিসরে কাজে লাগানো সম্ভব।
এরপর আসে বাস্তব এবং প্রমাণ-ভিত্তিক শক্তির উৎস অর্থাৎ Energy harvesting। এটাকেই অনেকেই ভুল করে ফ্রি এনার্জি মনে করেন। তবে বাস্তবে এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক উৎস থেকে শক্তি নেওয়ার একটি পদ্ধতি। সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, জোয়ার-ভাটা, বর্জ্য তাপ, পরিবেশের কম্পন, বাতাসে ভাসমান রেডিও সিগন্যাল এসব উৎসকে কাজে লাগানো যায় কারণ প্রকৃতি সেগুলো সরবরাহ করে। এগুলো সত্যিকার অর্থেই মানুষকে প্রায় নিখরচায় শক্তি দেয়। তবে এটিও ম্যাজিক্যাল ফ্রি এনার্জি নয়; বরং প্রকৃতির বিদ্যমান শক্তি আমরা সংগ্রহ করি। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, দক্ষতা হ্রাস, আবহাওয়া পরিবর্তন এসবই এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যাই হোক, সৌরশক্তি এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল শক্তি উৎসগুলোর একটি। দাম কমছে, দক্ষতা বাড়ছে এবং বড় থেকে ছোট সব ধরনের যন্ত্রেই এর ব্যবহার বাড়ছে। একইভাবে বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ এবং ভূগর্ভীয় তাপ শক্তির মতো উৎসগুলোও মানবসভ্যতাকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। মানুষ যত উন্নত হচ্ছে, ততই এই শক্তির ব্যবহার আরও ব্যয়সাশ্রয়ী ও কার্যকরী হচ্ছে।
ফলে মূল প্রশ্নে ফিরে আসা যাক, ফ্রি এনার্জি কি সত্যিই আছে? বিজ্ঞানের ভাষায় উত্তরটি স্পষ্ট, সরল এবং একটাই উত্তর না, এমন কোনো সীমাহীন শক্তি নেই যার সাহায্যে কোনো ইনপুট ছাড়াই অনন্ত শক্তি পাওয়া যায়। তবে প্রকৃতিতে এমন অসংখ্য শক্তির উৎস আছে, যেগুলো প্রায় নিখরচায় এবং স্থায়ী। বিজ্ঞান এগুলোকেই কাজে লাগায়, এবং এগুলোই ভবিষ্যতের শক্তি ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।মানুষের কৌতূহল তাকে বারবার এমন শক্তির সন্ধানে ঠেলে দেয় যা সীমাহীন, বিনা খরচে পাওয়া যায় এবং সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম অটল, শক্তি কখনোই হঠাৎ সৃষ্টি হয় না। তবে এর মানে এই নয় যে মানুষের আশা শেষ। বরং বিজ্ঞানের বদৌলতে আমরা জানতে পারি, প্রকৃতির মধ্যেই অসংখ্য শক্তির উৎস লুকিয়ে আছে, যেগুলোকে আমরা বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সংগ্রহ করতে পারি। সত্যিকারের উন্নতি সেখানে, যেখানে মানুষ প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলেও ভবিষ্যতের জন্য স্থায়ী সমাধান খুঁজে পায়। তাই ফ্রি এনার্জির মিথ ভেঙে ফেলেও আমরা আশাবাদী যে বিজ্ঞান আমাদের টেকসই ভবিষ্যতের শক্তির উৎসের দিকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
লেখক : ইমাম হোসাইন আনজির
তথ্যসূত্র : Thermodynamics: An Engineering Approach — Çengel & Boles, Atkins’ Physical Chemistry — Peter Atkins, Feynman Lectures on Physics — Richard Feynman, Review of Modern Physics — Casimir Effect Reviews, IEEE Energy Harvesting Reviews, IRENA Renewable Energy Reports, Science & Nature Cold Fusion Archives, Voodoo Science — Robert L. Park