শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৬ অপরাহ্ন

উন্নত বিশ্বের নতুন মহামারী ‘সিঙ্গেলহুড’

আলোকিত স্বপ্নের বিডি
  • প্রকাশের সময় : শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫

মানব ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, জুটি বাঁধাটা কেবল সামাজিক প্রথা ছিল না, ছিল এক অপরিহার্য বাস্তবতা। এই কারণে বিয়ে বা যেকোনো ধরনের সম্পর্কের প্রথাটি যে গতিতে পরিত্যক্ত হচ্ছে, তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। উন্নত বিশ্বজুড়ে ‘সিঙ্গেলহুড’ বা একা থাকার প্রবণতা যেন এক নতুন মহামারীর রূপ নিয়েছে।

২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী আমেরিকানদের মধ্যে, কোনো সঙ্গী বা পার্টনার ছাড়া বসবাসকারী পুরুষের সংখ্যা গত পাঁচ দশকে দ্বিগুণ হয়ে ‘৫০ শতাংশে’ দাঁড়িয়েছে, আর নারীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ‘৪১ শতাংশ।’দ্য ইকোনমিস্ট-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ৩০টি ধনী দেশের মধ্যে ২৬টিতেই একা বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, এবং ২০১৭ সালের তুলনায় জুটি বাঁধার হার যদি একই থাকত, তবে আজ বিশ্বে কমপক্ষে ‘১০ কোটি কম’ সিঙ্গেল মানুষ থাকত। বিশ্বজুড়ে চলছে এক বিশাল ‘সম্পর্কের মন্দা।’একদল এই প্রবণতাকে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত লক্ষণ বলে মনে করছেন, অন্যদিকে ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘ভোগ’ একে ‘প্রশংসনীয় আত্মনির্ভরতার প্রতীক’ হিসেবে দেখছে, যেখানে আধুনিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণীদের জন্য বয়ফ্রেন্ড থাকাটা ‘লজ্জাজনক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।আসলে, এই সিঙ্গেলহুডের উত্থানকে এককথায় ভালো বা খারাপ বলা চলে না। কর্মক্ষেত্রে নারীদের বাধাগুলো সরে যাওয়ায় তাদের পছন্দের পরিধি এখন অনেক বিস্তৃত। নারীরা যত বেশি আর্থিকভাবে স্বাধীন হচ্ছেন, তত কম তারা একজন অযোগ্য বা নির্যাতনকারী সঙ্গীর সঙ্গে জীবন কাটাতে রাজি হচ্ছেন। তবে মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। একা থাকাটা একদিকে যেমন মুক্তির স্বাদ দেয়, তেমনই তীব্র একাকীত্বও নিয়ে আসে। যদিও অনেক সিঙ্গেল মানুষই মুখে বলেন যে তারা এভাবেই খুশি—বিশেষ করে নারীরা—কিন্তু বিভিন্ন দেশের জরিপ বলছে, ‘৬০ থেকে ৭৩ শতাংশ’ মানুষই আসলে একটি সম্পর্কে থাকতে চান। ২০১৯ সালের আমেরিকার এক জরিপে দেখা যায়, যদিও ‘৫০ শতাংশ’ সিঙ্গেল সক্রিয়ভাবে সঙ্গী খুঁজছিলেন না, তবে তাদের মধ্যে মাত্র ‘২৭ শতাংশ’ বলেছেন যে তারা সিঙ্গেল থাকাটা উপভোগ করছেন। বাকিরা হয়তো মনের মতো সঙ্গী খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছেন, অথবা বাজারে থাকা সঙ্গীরা তাদের পছন্দসই নয়।যদি এত মানুষ জুটি বাঁধতে চেয়েও না পারে, তবে সম্পর্কের ‘বাজারে’ নিশ্চয়ই বড়সড় কোনো গড়মিল রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডেটিং অ্যাপগুলো অবাস্তব প্রত্যাশা তৈরি করেছে এবং অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে স্বভাব সৃষ্টি করেছে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেড়ে চলা রাজনৈতিক বিভেদ, যেখানে ছেলেরা ডানপন্থী এবং মেয়েরা বামপন্থী দিকে ঝুঁকছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে জীবন কাটানোয় সামাজিক দক্ষতার অভাব দেখা দিয়েছে। তবে সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ হলো, একা থাকাটা সহজ হয়ে যাওয়ায় নারীদের প্রত্যাশার পারদও চড়েছে। নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি করে চান যে তাদের সঙ্গী সুশিক্ষিত এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল হোক, কিন্তু বহু পুরুষ শিক্ষাগতভাবে নারীদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে এবং চাকরির বাজারে হিমশিম খাওয়ায় এই ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে।আলোকিত দেশ হিসেবে পরিচিত নর্ডিক দেশগুলোতেও (যেমন ফিনল্যান্ড ও সুইডেন) সিঙ্গেলহুডের এই স্রোত কমার কোনো লক্ষণই নেই। এই পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে জন্মহারের নাটকীয় পতনকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এছাড়াও, যেহেতু তরুণ, অবিবাহিত পুরুষরা বেশি সহিংস অপরাধ করে, তাই কম জুটি বাঁধা একটি বিশ্ব আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এমনও হতে পারে যে সম্পর্কের এই মন্দা আর কখনোই ঠিক হবে না।এই কারণে ‘৭ শতাংশ’ তরুণ সিঙ্গেল বলছেন, তারা একটি ‘এআই সঙ্গীর’ সঙ্গে রোবোটিক প্রেম করতেও রাজি! এআই সঙ্গী ধৈর্যশীল, এবং রোবট ব্যক্তিগত কাজ বা আরও ভালো চাকরি খুঁজতে বলে না—যা এই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

কম দম্পতি এবং কম শিশুর একটি বিশ্ব হয়তো আরও বিষণ্ণ এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, তবে এই সম্ভাবনা নিয়ে শুধু আক্ষেপ করলেই তা এড়ানো যাবে না। নির্মাণ সংস্থা থেকে শুরু করে কর বিভাগ পর্যন্ত, সবারই এই পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

সংবাদটি শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ
  • © All rights reserved © 2019 alokitoswapner-bd.com - It is illegal to use this website without permission.
Design & Developed by Freelancer Zone
themesba-lates1749691102