ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় শুধু ইবাদত নয়, বরং সময়, জীবন, সমাজ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, এমনকি দিন-মাস ও সন-তারিখও এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কোরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বারবার সময়ের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। একজন মুসলিমের জীবন যখন ইসলামী আদর্শে গঠিত হবে, তখন তার জীবনের ক্যালেন্ডারও হবে ইসলামী ক্যালেন্ডার অর্থাত্ হিজরি সন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজ আমরা হিজরি সন ভুলতে বসেছি। তাই একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে হিজরি সন গণনা ও হিসাব রাখা কেন জরুরি—এ নিয়ে আলোচনাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
হিজরি সনের পরিচয় ও উত্পত্তি
হিজরি সন ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়। খলিফা উমর ইবন খাত্তাব (রা.) ১৭ হিজরিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই সনের প্রবর্তন করেন। হিজরতের বছরকে গণনার সূচনা বিন্দু ধরা হয় এবং মুহাররম মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।
কোরআনের আলোকে সময় ও সনের গুরুত্ব
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২টি, আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকেই। এর মধ্যে চারটি মাস পবিত্র।’ (সুরা আত-তাওবা, আয়াত : ৩৬)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মাস ও বছরের হিসাব আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং তা ১২ মাসে বিভক্ত। এর ভিত্তি হচ্ছে চন্দ্র-চক্র, যা হিজরি সনের ভিত্তি।
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন : ‘তারা আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ ও হজের সময় নিরূপণের উপকরণ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৯)
এ আয়াত প্রমাণ করে যে ইসলামে সময় গণনার ভিত্তি চন্দ্র মাস বা হিজরি মাস। তাই আমাদের জীবনাচরণ ও ইবাদত ব্যবস্থায় হিজরি সন ব্যবহার অপরিহার্য।
হাদিসের আলোকে হিজরি সনের ব্যবহার
রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে হিজরি সন প্রচলন করেননি, তবে তাঁর সময় থেকেই চাঁদ দেখার মাধ্যমে মাস গণনা হতো। তিনি ইরশাদ করেছেন : ‘তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো এবং চাঁদ দেখে রোজা ভাঙো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০৯)
এ হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, ইসলামে দিন ও মাস নির্ধারণ হয় চাঁদ দেখে, অর্থাত্ হিজরি পদ্ধতিতে।
ইবাদতের সঙ্গে হিজরি সনের সম্পর্ক
ইসলামের প্রতিটি মৌলিক ইবাদতের সময় হিজরি মাস ও সনের সঙ্গে জড়িত। যেমন—
রোজা : প্রতি বছর রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ। রমজান হলো হিজরি ক্যালেন্ডারের নবম মাস।
হজ : হিজরি বছরের ১২তম মাস জিলহজ্বে হজ্জ আদায় করা হয়।
জাকাত : এক পূর্ণ হিজরি বছর অতিবাহিত হলে যাকাত আদায় করা আবশ্যক।
কোরবানি, ইতিকাফ : সবকিছু হিজরি মাস অনুসারে নির্ধারিত।
মহররম, আশুরা, শবে কদর, শবে বরাত : এসব রাত ও দিন হিজরি মাসের সাথেই সম্পর্কিত।
মেরাজুন্নাবী (সা.) ও মিলাদুন্নাবী ( সা.) : হিজরি সন হিসেবেই এ দিবস গুলো পালিত হয়।
ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা : চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা পালিত হয়।
তাই যদি একজন মুসলিম হিজরি সন ও মাসের হিসাব না রাখে, তাহলে তার ইবাদতের সময় ও গুরুত্ব ঠিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
ইতিহাস ও সংস্কৃতির সংরক্ষণে হিজরি সন
ইসলামী ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণের জন্য হিজরি সন অপরিহার্য। হিজরতের পর ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা, যুদ্ধ-বিজয়, বিজয় দিবস, খিলাফত প্রতিষ্ঠা—সবই হিজরি সনের সঙ্গে জড়িত। যদি আমরা হিজরি সন ভুলে যাই, তাহলে ধীরে ধীরে এই সব ঐতিহাসিক অর্জন ও তাত্পর্য হারিয়ে যাবে।
আধুনিক সময়ে হিজরি সন ভুলে যাওয়ার কারণ
১.পশ্চিমা ক্যালেন্ডারের প্রভাব : শিক্ষা, সরকারী কার্যক্রম, গণমাধ্যমে শুধু ইংরেজি সন ব্যবহারের ফলে হিজরি সন উপেক্ষিত হচ্ছে।
২.ধর্মীয় অবজ্ঞা : অনেক মুসলিম ধর্মীয় মাস ও দিন মনে রাখে না, ফলে হিজরি সনের প্রয়োজন অনুভব করে না।
৩.পারিবারিক ও সামাজিক চর্চার অভাব : হিজরি মাসে শিক্ষা বা সেমিনার হয় না বললেই চলে। ফলে ধীরে ধীরে এর গুরুত্ব লোপ পাচ্ছে।
হিজরি সন গণনার উপকারিতা
১.ইবাদতের সময় ঠিক রাখা : হিজরি সন জানলে রোজা, হজ, জাকাত সময়মতো আদায় সম্ভব।
২.ইতিহাস চর্চা : মুসলিম ইতিহাসকে সংরক্ষণ ও চর্চা সহজ হয়।
৩.শুদ্ধ ইসলামী সংস্কৃতি গঠন : মুসলিমদের আলাদা পরিচয় তৈরি হয়।
৪.নতুন প্রজম্মের মধ্যে ইসলামী চেতনা বৃদ্ধি : সন্তানদের মাঝে ধর্মীয় সচেতনতা বাড়ে।
৫.উম্মাহর ঐক্য ও পরিচয়ের বাহক : হিজরি সন গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য একীভূত সাংস্কৃতিক সময়।
ব্যক্তিগত জীবনে হিজরি সন ব্যবহারে কিছু উপায়
১. ক্যালেন্ডার ও ডায়েরিতে হিজরি সন ব্যবহার করা।
২. জন্মদিন, বিয়ে, মৃত্যুবার্ষিকী ইত্যাদি হিজরি সনে স্মরণ করা।
৩. ঘরে হিজরি ক্যালেন্ডার টানিয়ে রাখা।
৪. শিশুদের হিজরি মাস ও সনের শিক্ষা দেওয়া।
৫. মসজিদ ও মাদরাসায় হিজরি তারিখ ব্যবহার করা।
একটি কাজের তালিকা :
১. আজ থেকেই হিজরি তারিখ মনে রাখার চেষ্টা করুন।
২. প্রতি মাসের ১ তারিখে পরিবারের সঙ্গে হিজরি মাসের তাত্পর্য আলোচনা করুন।
৩. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিজরি মাস ও বছরের তাত্পর্য তুলে ধরুন।
৪. ইসলামী অনুষ্ঠানগুলোতে হিজরি তারিখ লিখুন ও প্রচার করুন।
৫. শিশুকে হিজরি মাসের নাম মুখস্থ করান ও প্রতিযোগিতা করুন।
পরিশেষে, ইসলামী জীবনব্যবস্থার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো হিজরি সন। একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে শুধু কোরআন-হাদিস জানাই যথেষ্ট নয়; বরং জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে—হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসরণ করাই এক আদর্শ জীবনচর্চা। হিজরি সনের চর্চা ও গণনা আমাদের ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের অঙ্গ। তাই আসুন, আমরা প্রত্যেকে হিজরি সন হিসাব রাখা শুরু করি এবং ইসলামী পরিচয়কে আত্মস্থ করি।