ঝালকাঠির রাসেল গাজীপুরের বাসন এলাকায় ডিজাইন এ্যাপারেল কোং গার্মেন্টস কর্মীদের একজন ছিলেন। শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি দাবীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। তাহার পরিবার এখন কষ্ট আর দুঃখের বিষয় সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে কাঁদে।
তিনি বলেন, আমি এই কষ্ট কিভাবে সহ্য করব। আমার সোনার ছেলে পৃথিবী থেকে চলে গেছে, আমি এখন কাকে নিয়ে আশায় বুক বানব’। এভাবেই বলতে বলতে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন নিহত রাসেলের পিতা হান্নান হাওলাদার।
ঢাকার গাজীপুরে শ্রমিক আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহত ডিজাইন এক্সপোর্ট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর বিদ্যুৎ মিস্ত্রী রাসেল হাওলাদার (২২) এর বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। বাগানে তৈরী করা হয়ে গেছে কবর। স্বজনসহ গ্রামের সবার অপেক্ষা রাসেলের জন্য। কিন্তু এই গরীব পরিবারের নিরীহ রাসেল আসছে এবার লাশ হয়ে। তার মৃত্যুতে শোকাহত গ্রামের মানুষ। আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে।
গত ৩০ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১২ টার দিকে রাসেলের গুলিবিদ্ধ হবার সংবাদ পেয়ে পরিবারের সবাই নিশ্চুপ ও নির্বাক। রাসেলের বেতনের টাকায় যে সংসার ও ছোট ভাইয়ের পড়াশুনার খরচ চলত সেই সন্তান ও ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদে পরিবারটি দিশেহারা। তার একমাত্র আশা ছিল সামান্য বেতনের টাকা জমিয়ে বাড়িতে নিজেদের একটি ঘর করার। এরপর ভাড়া বাসা ছেড়ে বাব মা ভাইকে নিয়ে নিজের বাড়িতে উঠে বিয়ে করার আশাটুকু এখন শুধুই স্মৃতি। এই স্মৃতি নিয়েই তার স্বজনদের বেঁচে থাকতে হবে।
নিহত রাসেলের গুলিবিদ্ধ হবার আগে তার সাথে থাকা কোম্পানীর অপর বিদ্যুৎ মিস্ত্রী মো. সুফিয়ান বলেন, কোম্পানীতে রাসেল আর আমি দুজন একই পদে চাকরি করতাম। আমাদের কোম্পানীতে কোন আন্দোলন হয়নি। কিন্তু অন্য ফ্যাক্টরীতে আন্দোলন করায় মালিক পক্ষ আমাদের সকল শ্রমিকদের দ্রুত ছুটি দিয়ে দেয়ায় আমরা সবার শেষে বের হয়েছি। তখন আমরা বাসার যাবার সময় খোলা মাঠের মাঝে আসার সাথে সাথে পুলিশের গুলিতে রাসেল গুলিবিদ্ধ হয়। প্রথম গুলিটি ওর বুকের ডান পাশে দ্বিতীয় গুলি হাতে লাগে। তখন রাসেল বাবা মা বলে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়। আমি তখন তাকে নিয়ে টঙ্গি হাসপাতালে যাই। আমার কোলেই পথের মাঝে মারা যায়। রাসেল খুব শান্ত এবং পরিশ্রমী ছিল। কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে টাকা জমাতো। আমার সাথে বলত ১৩ হাজার টাকা বেতনের এই টাকা দিয়ে কবে বাড়ির জমিতে ঘর তুলতে পারব। মাঝে মাঝে আমার কাছ থেকেও টাকা ধার নিত।
কথা হয় রাসেলের বাবা মো. হান্নান হাওলাদারের সাথে। তিনি তার সন্তানের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি কাঠ বিক্রির ছোট ব্যবসা করি। আমার ২ ছেলে, ১ মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। রাসেল বড়। ছোট ছেলে নাইম হাওলাদার এবার এইচএসসিতে বিনয়কাঠি কলেজে পড়া শুনা করে। ওর পড়াশুনা এবং সংসারের খরচ বহন করত রাসেল। কত টাকা বেতন পায় কোন দিন জানতে চাইনি। রাসেলের সাথে আমার শেষ কথা হয় ২৯ অক্টোবর রাতে। প্রায়ই ও আমাকে বেতন পেলে কিছু টাকা পাঠাতো। যা দিয়ে সংসার এবং ছোট ছেলের পড়াশুনার খরচ চালাতাম। প্রতিদিন আমাদের খোজ খবর নিত। টাকার অভাবে এইচএসসি পাশ করার পর আর পড়াতে পারি নাই। তাই এই কোম্পানীতে কাজ পেয়ে ঢাকায় চলে যায় ৭ বছর আগে। বাবা হান্নান জানান, ওর জীবনের একটা স্বপ্নই ছিল। সেটা হলো আমাদের ভাড়া বাড়ি থেকে নিয়ে নিজস্ব জমিতে ঘর নির্মান করে বিয়ে করবে। মায়ের সাথে ২৯ তারিখেও কথা হয়েছে। ঝালকাঠির বিনয়কাঠি ইউনিয়নে বালকদিয়া গ্রামে একটি ভাড়া বাসায় থাকত রাসেলের পরিবার। ৩ বছর আগে পার্শবর্তি নিজেদের জমিতে ঘর নির্মানের কাজ শুরু করে। বাবা হান্নান সেই নির্মানাধীন ঘর দেখিয়ে বলেন, এই ঘর আর হবে কিনা জানিনা। আমার সংসারের অভিভাবক ছিল রাসেল। আমার স্বচ্ছলতা থাকলে ওকে আমি এই চাকরী করতে দিতামনা। কিন্তু আজকের সে নিরপরাধ হয়েও পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ায় আমি এর ন্যায় বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করছি সরকারের কাছে।
মা রাশিদা বেগম বলেন, আমাকে বাবায় বলছে মা আমি ডিসেম্বরে আসব। তোমার জন্য কি আনব জানাবা। আমি বলছি তুমি সহিসালামতে ফিরে আসো। এইডাই আমি চাই আল্লাহর কাছে। একমাত্র বোন মিম আক্তার সব সময় ভাইয়ের খোজ খবর নেয়ার স্মৃতিচারন করে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। বলেন আর ভাই আমাকে ফোন করবেনা। রাত ৭টা ১৫ মিনিটে ঢাকা থেকে রাসেলে লাশবাহি গাড়িটি বাড়িতে আসে। এশার নামাজের পর জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়।