শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৩১ অপরাহ্ন

গাইনেকোমাস্টিয়া: পুরুষের স্তনবৃদ্ধির কারণ ও সমাধান

আলোকিত স্বপ্নের বিডি
  • প্রকাশের সময় : বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৫

মানুষের শরীর প্রতিদিন নানা ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। বেশিরভাগ পরিবর্তনই স্বাভাবিক, আবার কিছু পরিবর্তন আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে এবং প্রশ্ন তৈরি করে এর পেছনে কারণটা কী? পুরুষদের স্তনবৃদ্ধি বা গাইনেকোমাস্টিয়া ঠিক এমনই একটি পরিবর্তন, যা অনেকেই বিব্রতবোধ করে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু বিজ্ঞান বলে, এ অবস্থা মোটেও বিরল নয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও নিরীহ একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া।

গাইনেকোমাস্টিয়া বলতে মূলত স্তনের ভেতরে থাকা গ্রন্থিযুক্ত টিস্যুর বৃদ্ধি বোঝায়, যা পুরুষদের ক্ষেত্রেও সাময়িক বা স্থায়ীভাবে ঘটতে পারে। অনেকেই এটিকে চর্বি জমে যাওয়া মনে করেন, কিন্তু প্রকৃত গাইনেকোমাস্টিয়ায় শুধুমাত্র চর্বি নয়, স্তনগ্রন্থিও বড় হয়ে যায়। এই গ্রন্থিজনিত বৃদ্ধি সাধারণত হরমোনের সাময়িক ভারসাম্যহীনতার ফল।

শিশুকাল থেকে বার্ধক্য, জীবনের বিভিন্ন ধাপে পুরুষদের মাঝে গাইনেকোমাস্টিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।

নবজাতকের ক্ষেত্রে মাতৃ-হরমোনের প্রভাবে স্বল্পসময়ের জন্য স্তন ফুলে উঠতে পারে। আবার কৈশোরে, যখন শরীর দ্রুত হরমোন উৎপাদন শুরু করে, তখন মুহূর্তের মধ্যে ইস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টেরনের ভারসাম্য বদলে যায় এবং ছেলেদের মধ্যে স্তনবৃদ্ধি দেখা দেয়। গবেষণা বলছে, কিশোরদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এই সমস্যার মুখোমুখি হয়, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই–তিন বছরের মধ্যে এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে সেরে যায়।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরুষদের টেস্টোস্টেরনের মাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ফলে তুলনামূলকভাবে ইস্ট্রোজেনের প্রভাব কিছুটা বেড়ে যায় এবং তখনও গাইনেকোমাস্টিয়া দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ওজন বৃদ্ধি, অ্যালকোহল আসক্তি, লিভারের সমস্যা, থাইরয়েডের অতিসক্রিয়তা, কিডনি রোগ, কিছু অ্যান্টিসাইকোটিক ও অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ওষুধ, এমনকি বডিবিল্ডিংয়ে ব্যবহৃত অ্যানাবলিক স্টেরয়েড।সবই এই অবস্থাটির ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

গাইনেকোমাস্টিয়া নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রথমেই দেখা হয় এটি সত্যিকারের গ্রন্থিজনিত বৃদ্ধি কিনা, নাকি শুধুই চর্বি জমে যাওয়ার ফল। অনেক ক্ষেত্রে মোটা পুরুষদের স্তনে অতিরিক্ত চর্বি জমে এমনভাবেই ফুলে দেখা যায়, যা আসলে পসুডোগাইনেকোমাস্টিয়া এর মধ্যে কোনো গ্রন্থি বৃদ্ধি থাকে না। চিকিৎসকের স্পর্শ-পরীক্ষা সাধারণত এই দুই অবস্থার পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে। যদি ঘন, গোলাকার, স্তনের ঠিক নিচে শক্ত টিস্যু স্পষ্ট অনুভূত হয়, তবে সেটি প্রকৃত গাইনেকোমাস্টিয়া হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো জটিল পরীক্ষা দরকার হয় না। কৈশোরে দেখা দেওয়া স্বাভাবিক গাইনেকোমাস্টিয়ায় সাধারণত চিকিৎসাও লাগে না। তবে যদি দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে, ব্যথা থাকে, একদিকে গাঁটের মতো শক্ত লাগে বা বয়সের তুলনায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা যায় তাহলে রক্তপরীক্ষা কিংবা আল্ট্রাসাউন্ডের মতো ইমেজিং করানো হয়, যাতে হরমোনজনিত সমস্যা বা কোনো বিরল টিউমারের সম্ভাবনা যাচাই করা যায়।

চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ধাপে ধাপে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যদি অবস্থাটি নতুন হয় এবং ব্যথা বা অস্বস্তি থাকে, তবে হরমোনের ভারসাম্য ঠিক রাখে এমন ওষুধ বিশেষ করে ট্যামোক্সিফেন অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এটি স্তনগ্রন্থির অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে দীর্ঘদিন ধরে থাকা ফাইব্রোটিক টিস্যু সাধারণত ওষুধে কমে না। সেক্ষেত্রে সার্জারি সবচেয়ে সফল সমাধান। আধুনিক লিপোসাকশন ও গ্রন্থিতন্তু অপসারণ প্রযুক্তি ব্যবহারে বর্তমানে অপারেশনের কাটা দাগ খুবই ছোট হয় এবং সৌন্দর্যগত ফলাফলও ভাল থাকে।

ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা

যেসব ক্ষেত্রে গাইনেকোমাস্টিয়া নতুনভাবে শুরু হয়েছে (৬ মাসের কম), ব্যথা অনুভব হয় এবং কোনো স্পষ্ট কারণ নেই সেসব পরিস্থিতিতে কিছু ওষুধ ব্যবহার করা যায়। গাইনেকোমাস্টিয়ার জন্য সাধারণত তিন ধরনের ওষুধ ব্যবহৃত হয়: অ্যান্ড্রোজেন, অ্যান্টি-ইস্ট্রোজেন, এবং aromatase inhibitors।

টেস্টোস্টেরন সাধারণত স্থায়ী বা দীর্ঘদিনের গাইনেকোমাস্টিয়ায় তেমন কাজ করে না, কারণ একবার ফাইব্রোসিস হয়ে গেলে ওষুধে সাড়া পাওয়া কঠিন। Dihydrotestosterone ভালো ফল দেখালেও সহজলভ্য নয়। Danazol কিছু রোগীর ক্ষেত্রে উপকার করলেও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশ বেশি যেমন edema, acne ও muscle cramps।

অ্যান্টি-ইস্ট্রোজেনের মধ্যে clomiphene citrate প্রায় ৬৪% রোগীর উন্নতি ঘটাতে পারে, তবে সাধারণত উচ্চ ডোজে ভালো সাড়া পাওয়া যায়।

সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ অপশন হিসেবে বিবেচিত হয় tamoxifen। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে tamoxifen নেওয়া ৭৮–৯০% রোগীর উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। এর ডোজ সাধারণত দিনে ১০ mg দু’বার বা ২০ mg একবার, তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত। এক মাসের মধ্যেই ব্যথা কমতে শুরু করে।

Raloxifene-ও ব্যবহার হয়েছে, তবে পর্যাপ্ত গবেষণা নেই। Aromatase inhibitors যেমন anastrozole ও letrozole তাত্ত্বিকভাবে কাজে লাগতে পারে, কিন্তু বড় কোনো গবেষণায় নিশ্চিত ফল পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে কৈশোরকালীন গাইনেকোমাস্টিয়ায় এদের কার্যকারিতা দেখা যায়নি। Anastrozole-এ কিছু পুরুষের শরীরের চর্বি বৃদ্ধি ও যৌনক্ষমতা হ্রাসের প্রমাণ রয়েছে।

মূল কথা হলো নতুন, ব্যথাযুক্ত ও সাম্প্রতিক গাইনেকোমাস্টিয়ায় tamoxifen সবচেয়ে কার্যকর। কিন্তু দীর্ঘদিনের বা ফাইব্রোটিক গাইনেকোমাস্টিয়ায় ওষুধ সাধারণত কাজ করে না।সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা

যখন ওষুধে কাজ হয় না, গাইনেকোমাস্টিয়া দীর্ঘদিনের, দৈনন্দিন জীবনে মানসিক বা শারীরিক সমস্যা তৈরি করছে অথবা ক্যান্সারের সন্দেহ আছে তখন সার্জারি প্রয়োজন।

সার্জারিতে সাধারণত অতিরিক্ত গ্রন্থি-টিস্যু অপসারণ করা হয়, অনেক সময় লিপোসাকশন যোগ করা হয় এবং রোগীর পরিস্থিতি অনুযায়ী পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। আধুনিক মিনিমালি ইনভেসিভ সার্জারিতে খুব ছোট দাগ রেখে দ্রুত সুস্থ হওয়ার সুযোগ থাকে। যদি ক্যান্সারের সন্দেহ থাকে, অপসারিত টিস্যুর হিস্টোলজি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক।

কৈশোরকালীন গাইনেকোমাস্টিয়া হলে সার্জারি সাধারণত বয়ঃসন্ধি শেষ হওয়ার পর করা উচিত, যাতে পরে পুনরায় বৃদ্ধি না ঘটে। সার্জারির আগে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে গাইনেকোমাস্টিয়ার মূল কারণ ইতিমধ্যে সমাধান হয়েছে।

গাইনেকোমাস্টিয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সামাজিক লজ্জা ও ভুল ধারণা। অনেকেই মনে করেন এটি পুরুষত্বের অভাব বা কোনো গুরুতর রোগের লক্ষণ। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে এটি পুরুষদের মধ্যেই অত্যন্ত সাধারণ একটি পরিবর্তন, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শরীর নিজেই এটিকে সামলে নেয়। সচেতনতা থাকলে অপ্রয়োজনীয় দুশ্চিন্তা কমে যায় এবং প্রয়োজন হলে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা নেওয়া যায়।

গাইনেকোমাস্টিয়া একটি স্বাভাবিক হরমোনজনিত অবস্থা, যা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পুরুষদের মধ্যে দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি ক্ষতিকর নয় এবং সময়ের সাথে স্বাভাবিকভাবে সেরে যায়। কিন্তু যদি সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়, দ্রুত বাড়তে থাকে বা দৈনন্দিন জীবনে অস্বস্তি তৈরি করে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অপরিহার্য। হরমোনের ভারসাম্য, জীবনযাত্রা, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা সব মিলিয়ে এটি একটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত ও সমাধানযোগ্য শারীরিক অবস্থা। সচেতনতাই এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকার।

আপনার মন্তব্য লিখুন

সংবাদটি শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ
  • © All rights reserved © 2019 alokitoswapner-bd.com - It is illegal to use this website without permission.
Design & Developed by Freelancer Zone
themesba-lates1749691102