মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত, সহিংসতা এবং খাদ্য সংকটের কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। গত দেড় বছরে এক লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন, ফলে বর্তমানে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় সংকট চরম আকার ধারণ করেছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশের সরকারকে বসবাসের ঘর বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিলেও এখনও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে এক লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন এবং তাদের নিবন্ধনও সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের জুন ও জুলাই মাসে সর্বোচ্চ অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
আশ্রয় সংকট ও গাদাগাদি অবস্থান
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে ১৩ লাখের বেশি নিবন্ধিত রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। তবে, নতুন আসা রোহিঙ্গারা এখনও এই পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ক্যাম্পে স্থান সংকুলান না হওয়ায়, নতুন রোহিঙ্গারা গাদাগাদি করে থাকার জন্য বাধ্য হচ্ছেন।
রাখাইনে চলমান সংঘাত ও নির্যাতন
নতুন আসা রোহিঙ্গাদের ভাষ্যমতে, তারা আরাকান আর্মি এবং আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) এর মধ্যে চলমান সংঘর্ষ, নিপীড়ন, অপহরণ, হত্যা এবং জোরপূর্বক সশস্ত্র দলে ভর্তির চাপ থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। এর মধ্যে বুথেডং অঞ্চলে রোহিঙ্গা যুবকদের জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োজিত করা হচ্ছে।
অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে জটিলতা
টেকনাফের ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন জানান, সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সতর্ক রয়েছে এবং নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। তবে, দুর্গম সীমান্ত দিয়ে রাতের অন্ধকারে অনুপ্রবেশের ঘটনা বেড়েছে। বিজিবি টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান জানান, অনুপ্রবেশকারীদের আটকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা নেতাদের বক্তব্য
রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, “আরাকান আর্মি মংডু শহরের দখল নেওয়ার পর থেকে রোহিঙ্গাদের টার্গেট করছে। নির্যাতন, নিখোঁজ হওয়া, হত্যা—এসব যেন প্রতিদিনের ঘটনা।” তার মতে, আরাকান আর্মির আচরণ পরিবর্তন না হলে অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেন, “মিয়ানমার সরকার এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী উভয়ের নিপীড়নে রোহিঙ্গারা দিশেহারা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশ সরকারকে বাস্তবসম্মত ও টেকসই সমাধানের পথে অগ্রসর হতে হবে।”
আরআরআরসির অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, নতুন রোহিঙ্গাদের জন্য ক্যাম্পে ঘর বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘ চিঠি দিলেও, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পুরোনো ক্যাম্পগুলোতেই নতুনদের স্থাপনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে, তবে এটি স্থায়ী সমাধান নয়।”