মানুষ যখন রাতের আকাশে খালি চোখে তাকায়, তখন তারা অসংখ্য তারকাকে ঝিকমিক করতে দেখে। এই দৃশ্য হাজার বছর ধরে মানুষের কল্পনা, দর্শন আর বিজ্ঞানের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। কিন্তু আজকের আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এক বিস্ময়কর সত্য আমাদের সামনে হাজির করেছে আর সেটা হলো আমরা সবাই আসলে তারার ধূলিকণা দিয়ে তৈরি। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান এই কথাটিকে জনপ্রিয় “We are made of. starstuff stuf”
এর অর্থ হলো, আমাদের শরীরের প্রতিটি পরমাণু কোনো না কোনো সময়ে মহাবিশ্বের তারাদের ভেতরে তৈরি হয়েছে। আজ আমরা সেই বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক গল্পটিই বিস্তারিতভাবে জানব যে কীভাবে মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা থেকে শুরু করে তারার মৃত্যু পর্যন্ত নানা প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে আমাদের দেহের প্রতিটি মৌল।
মহাবিশ্বের জন্ম আর প্রথম মৌল
প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্বের জন্ম হয় মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে। শুরুতে সবকিছুই ছিল প্রচণ্ড তাপ আর ঘনত্বে আবদ্ধ। মহাবিস্ফোরণের কয়েক মিনিট পরপরই শুরু হয় এক বিশেষ ধাপ, যাকে বলা হয় বিগ ব্যাং নিউক্লিওসিন্থেসিস। এই ধাপে মহাবিশ্বে গঠিত হয় সবচেয়ে প্রাথমিক মৌলগুলো অর্থাৎ হাইড্রোজেন, হিলিয়াম আর সামান্য লিথিয়াম।
বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, আজকের মহাবিশ্বে সাধারণ পদার্থের ভরের প্রায় ৭৪ শতাংশই হাইড্রোজেন, প্রায় ২৪ শতাংশ হিলিয়াম আর মাত্র ২ শতাংশ হলো এর বাইরে অন্যান্য সব মৌল। অর্থাৎ, লোহা, অক্সিজেন, কার্বন, ক্যালসিয়াম, সোনা সব মিলিয়েই মোট ২ শতাংশ। অথচ এই সামান্য অংশই আমাদের গ্রহ, আমাদের শরীর আর আমাদের জীবনের ভিত্তি।
তবে বিগ ব্যাং পর্যায়ে শুধু হালকা মৌলই তৈরি হয়েছিল। ভারী মৌলগুলো তখনো জন্ম নেয়নি। তাহলে সেগুলো কোথা থেকে এলো? উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের যেতে হবে তারার ভেতরে।
তারার ভেতরে মৌল তৈরির কারখানা
একটি তারা আসলে এক বিশাল গ্যাস বল। এর কেন্দ্রে প্রচণ্ড তাপ আর চাপের কারণে হাইড্রোজেন একে অপরের সাথে সংঘর্ষ করে ফিউশনের মাধ্যমে হিলিয়ামে রূপ নেয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তি বের হয়, যা তারাকে উজ্জ্বল করে রাখে।
তারার বয়স যত বাড়ে, ততই এর কেন্দ্রে নতুন নতুন মৌল তৈরি হয়। মাঝারি ভরের তারা হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে, পরে হিলিয়ামকে কার্বন ও অক্সিজেনে রূপান্তরিত করে। আর বিশাল ভরের তারা এর থেকেও জটিল প্রক্রিয়ায় সিলিকন, সালফার, ক্যালসিয়াম এবং অবশেষে লোহা পর্যন্ত তৈরি করে।
কিন্তু এখানে একটা সীমা আছে। লোহা পর্যন্ত মৌল তৈরি করা যায় ফিউশনের মাধ্যমে। এর পরের ভারী মৌল (যেমন সোনা, ইউরেনিয়াম, প্লাটিনাম) তৈরি হয় একেবারে অন্য প্রক্রিয়ায় যা ঘটে বিস্ফোরণ আর মহাজাগতিক সংঘর্ষে।
বিস্ফোরণ ও মহাজাগতিক দুর্ঘটনায় ভারী মৌল
যখন একটি বিশাল ভরের তারা তার জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে, তখন সেটি ভেঙে পড়ে এবং একসময় ঘটে সুপারনোভা বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণ মহাবিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ঘটনা। এতে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় এবং প্রচণ্ড চাপে একসাথে অসংখ্য নিউট্রন মুক্ত হয়। এই নিউট্রনগুলো পরমাণুর কেন্দ্রে ধাক্কা খেয়ে নতুন নতুন ভারী মৌল তৈরি করে।
এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস আর সেটা হলো নিউট্রন তারার সংঘর্ষ। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো দুটি নিউট্রন তারার সংঘর্ষ থেকে আসা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, এই ধরনের সংঘর্ষে প্রচুর ভারী মৌল তৈরি হচ্ছে, যার মধ্যে সোনা, প্লাটিনাম, ল্যানথানাইডস ইত্যাদি রয়েছে।অতএব, আমাদের আঙুলে থাকা সোনার আংটি বা বিদ্যুতের তারে থাকা তামা এসবই একসময় কোনো এক সুপারনোভা বিস্ফোরণ কিংবা নিউট্রন তারার সংঘর্ষের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
মহাজাগতিক পুনর্ব্যবহার: এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম যে তারা বিস্ফোরিত হয়, তার ভেতরে তৈরি মৌলগুলো ছিটকে যায় চারদিকে এবং মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। এই ধূলিকণা ও গ্যাস মিলে তৈরি করে নতুন নক্ষত্রমণ্ডল, নতুন তারা, নতুন গ্রহ। অর্থাৎ মহাবিশ্বে চলছে এক মহাজাগতিক পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়া।
আমাদের সূর্যও এমনই দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের তারা। প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে, কোনো প্রাচীন তারার বিস্ফোরণ থেকে ছিটকে আসা মৌল একত্রিত হয়ে তৈরি করেছিল সৌরজগত। সেই সাথে জন্ম নেয় পৃথিবী। পৃথিবীর বুকে পরে রসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তৈরি হয় জীবন।
এ কারণেই বিজ্ঞানীরা বলেন আমাদের শরীরের প্রতিটি মৌল তারার ভেতরে গঠিত। আমাদের হাড়ে যে ক্যালসিয়াম আছে, সেটি কোনো এক প্রাচীন তারা বানিয়েছিল। রক্তের হিমোগ্লোবিনে থাকা লোহা একসময় গঠিত হয়েছিল সুপারনোভা বিস্ফোরণের ভেতর। এমনকি আমাদের শ্বাস নেওয়ার অক্সিজেনও তৈরি হয়েছিল বহু কোটি বছর আগে কোনো বিশাল তারা থেকে।জীবন ও গ্রহ গঠনে মৌলের ভূমিকা
মহাবিশ্বের মৌলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও সালফার। জীববিজ্ঞানে এগুলোকে সংক্ষেপে CHNOPS বলা হয়। জীবনের মৌলিক রাসায়নিক গঠন সম্ভব হয়েছে এই মৌলগুলোর জন্যই।
আবার গ্রহ গঠনের ক্ষেত্রেও ধাতব মৌলগুলো জরুরি। জ্যোতির্বিজ্ঞানে হিলিয়াম-হাইড্রোজেন ছাড়া বাকি সব মৌলকে বলা হয় মেটাল। একটি তারার চারপাশে যত বেশি মেটাল থাকে, তত বেশি সম্ভাবনা থাকে সেখানকার গ্রহ গঠনের। আমাদের সূর্যের ধাতব পরিমাণ বেশ ভালো, তাই এর চারপাশে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর মতো পাথুরে গ্রহ।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায় আমরা যদি তারাদের ভেতরে মৌল তৈরির এই মহাজাগতিক কারখানা না পেতাম, তবে কোনো গ্রহ, কোনো জীবন, কোনো সভ্যতাই তৈরি হতো না।
সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি
আজকের আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এই মহাজাগতিক প্রক্রিয়াগুলোকে আরও ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করছে।
স্পেকট্রোস্কপি প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা এখন তারাদের আলোর ভেতর থেকে মৌলের উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারি। এতে বোঝা যায় কোন তারায় কত ধাতু আছে।
গাইয়া স্যাটেলাইট আর অন্যান্য বিশাল সার্ভে আমাদের গ্যালাক্সির তারাগুলোর রাসায়নিক মানচিত্র তৈরি করছে।
মাল্টি-মেসেঞ্জার অ্যাস্ট্রোনমি, অর্থাৎ আলোর পাশাপাশি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, নিউট্রিনো ও অন্যান্য সংকেত ব্যবহার করে আমরা এখন মহাজাগতিক বিস্ফোরণ আর সংঘর্ষ থেকে আসল প্রমাণ পাচ্ছি।
এসব গবেষণা শুধু মহাবিশ্ব বোঝার জন্যই নয়, বরং পৃথিবীর বাইরের জীবনের সম্ভাবনা নির্ধারণেও সহায়ক হচ্ছে। কারণ, যেখানে মৌল বেশি, সেখানেই জীবনের রাসায়নিক উপাদান তৈরির সম্ভাবনা বেশি।
দর্শন ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি
আমরা সবাই তারার ধূলিকণা বাক্যটি শুধু বৈজ্ঞানিক তথ্য নয়, এটি আমাদের পরিচয়ের এক গভীর দার্শনিক ব্যাখ্যা। আমরা যখন আকাশের দিকে তাকাই, তখন আসলে নিজেদের অতীতের দিকে তাকাই। প্রতিটি মানুষের শরীরই মহাবিশ্বের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত। আমাদের অস্তিত্ব, চিন্তা, অনুভূতি সবই সম্ভব হয়েছে তারার মৃত্যুর কারণে।
এই উপলব্ধি মানুষকে বিনয়ী করে তোলে। আমরা বুঝতে পারি, মহাবিশ্বে আমরা ক্ষুদ্র হলেও, আমাদের ভেতরে বহন করছি কোটি কোটি বছরের মহাজাগতিক ইতিহাস।সর্বশেষ
“আমরা সবাই তারার ধূলিকণা” এই কথার পেছনে রয়েছে এক বিশাল বৈজ্ঞানিক সত্য। বিগ ব্যাংয়ে তৈরি হয়েছিল হালকা মৌল, তারার ভেতরে গঠিত হয়েছে ভারী মৌল, আর সুপারনোভা ও নিউট্রন তারার সংঘর্ষে তৈরি হয়েছে সবচেয়ে ভারী মৌল। সেই সব মৌল মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে নতুন তারা ও গ্রহ তৈরি করেছে, আর তারই ধারাবাহিকতায় এসেছে আমাদের পৃথিবী ও জীবন।
আমাদের শরীরের প্রতিটি অংশই একেকটি তারার উত্তরাধিকার বহন করছে। চোখে দেখা না গেলেও আমাদের ভেতরে আছে অক্সিজেন, কার্বন, লোহা, ক্যালসিয়াম সবই কোনো না কোনো তারার অন্তিম মুহূর্তের দান।
তাই, যখন আমরা রাতের আকাশে তারা দেখি, তখন মনে রাখা উচিত আমরা তাদের সাথেই একসূত্রে গাঁথা। আমরা শুধু আকাশের দিকে তাকাই না, আমরা নিজেদের উৎসের দিকে তাকাই। মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্য হলো এই যে, মানুষের জীবনের গল্প আসলে তারার গল্পেরই আরেক অধ্যায়।