দুই মহাদেশ কিন্তু এক দেশের বুক চিড়ে বয়ে চলা বসফরাস প্রণালী।
পবিপ্রবি প্রতিনিধিঃ
ধরুন, কোন নৌযানে করে ঘুরতে বেড়িয়েছেন। এমন একটি সামুদ্রিক অঞ্চল পাড়ি দিচ্ছেন যার এক পাশে এশিয়া এবং অন্য পাশে ইউরোপ। সূর্যের আলো পড়ে নীল জলরাশিগুলো হীরকের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে; দু’পাশে সৌখিন জনতা মৎস্য শিকারে ব্যস্ত; মোহনা জুড়ে শত শত ঐতিহাসিক নিদর্শন, দুর্গ কিংবা প্রাসাদ; জলরাশিতে হাঁসেদের কেলি করে বেড়ানো আর মাথার উপরে গাঙচিলদের অক্লান্ত দুপুরে ডানা মেলে বায়ু ভেদের প্রতিযোগিতা। কেমন অনুভব করবেন আপনি?
বলছি তুরস্কের বসফরাস প্রণালীর কথা। সাধারণত নৌযান চলার জন্য পর্যাপ্ত গভীরতা বিশিষ্ট সরু পানিপথ যা ভিন্ন দু’টি জলের উৎসকে সংযুক্ত করেছে, তাকেই বলা হয়ে থাকে প্রণালী। বসফরাস প্রণালী যুক্ত করেছে কৃষ্ণ সাগর এবং মর্মর সাগরকে। পৃথিবীর সবচাইতে সরু এবং ২য় ব্যস্ততম এই প্রণালীটি তুরস্কের ইস্তাম্বুল নগরে অবস্থিত বলে একে অনেক সময় ইস্তাম্বুল প্রণালীও বলা হয়ে থাকে। তবে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম/পত্রিকা/সাহিত্য/মানুষের মুখে মুখে যে নামটি শক্তিশালী স্থান দখল করেছে সেই বসফরাস শব্দটির পেছনে রয়েছে গ্রীকদের এক পৌরাণিক কাহিনী/রুপকথা। বসফরাস শব্দটি এসেছে থ্রেসিয়াস একটি শব্দ থেকে যার অর্থ “গরুর যাত্রাপথ”। গ্রীকদের পৌরাণিক বিশ্বাসমতে, দেবতা জিউসের স্ত্রী হীরা তার স্বামীর পরকীয়া সন্দেহেবশে মাউন্ট অলিম্পাস থেকে থেকে নেমে আসেন সন্দেহের বাস্তব প্রমান পেতে। জিউস তার অপকর্ম আড়াল করতে নিজ প্রেমিকা আইও’কে একটি সাদা গাভীতে রুপান্তরিত করেন।
বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে বসফরাস প্রণালী পেয়েছে ইতিহাসের, শত নির্মানের, ধর্মের, চুক্তির এমনকি রক্তের স্পর্শ। তাকে কেন্দ্র করে হয়েছে যুদ্ধ, হয়েছে কয়েকটি চুক্তি। কারণ বসফরাস অনেকগুলো দেশের বাণিজ্যিক অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত। বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, রাশিয়া, রোমানিয়া, জর্জিয়ার মতো দেশগুলোর আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য পথ হিসেবে একমাত্র বসফরাস প্রণালী ছাড়া আর কোন উপায় নেই বললেই চলে। একে ব্যবহার করে বৈশ্বিক তেল বাণিজ্যের সাথে জড়িত রাশিয়া এবং কাসপিয়ান সাগরের উপকূলীয় দেশগুলো প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লাখ ব্যারেল তেল পরিবহন করে চলেছে। প্রতি বছর যাতায়াত করে প্রায় ৪৮ হাজার মালবাহী জাহাজ। এছাড়া স্থানীয়, পর্যটকদের জন্য ফেরিসহ রয়েছে বহুবিদ ব্যবস্থা। দার্দেনেলস প্রণালীর সাথে যুক্ত হয়ে এটি আবার তৈরি করেছে বিস্তৃত “তুর্কি প্রণালী”। দার্দেনেলস থেকে ভূমধ্যসাগর, ভূমধ্যসাগর থেকে জিব্রালটার প্রণালী হয়ে উত্তর আর্টলান্টিক সাগর এবং মিশরের সুয়েজ খাল হয়ে লোহিত সাগর, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরের সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়েছে এই বসফরাস প্রণালী। তাইতো পুরো বিশ্ব একে নিয়ে করেছে রাজনীতি, যুদ্ধ; বিভিন্ন সময় গড়ে তুলেছে সামরিক ঘাঁটি।
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকেই মানুষ বসফরাসকে মমতা-স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছে। তখন নগরের নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল । ১৪৫৩ সালের ২৯ মে উসমানীয় সাম্রাজ্য দ্বারা এই সাম্রাজ্যটির পতন ঘটে এবং নগরের নতুন নাম হয় ইস্তাম্বুল। তখন থেকে বসফরাস প্রণালী আরও বেশি গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠে। উভয়তীরে নির্মাণ করা হয় শক্তিশালী দূর্গ। পুরো কৃষ্ণ সাগর চলে আসে অটোম্যান/উসমানীয়দের দখলে। বলা হয়ে থাকে, কলম্বাস কর্তৃক অ্যামেরিকা আবিষ্কারের দ্বারও উন্মোচিত হয় এই প্রণালীতে। ১৮৭৭ ও ১৮৭৮ সালে রাশিয়া ও অটোম্যানদের যুদ্ধ হয় বসফরাসের কর্তৃত্বকে কেন্দ্র করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সেভেরেস চুক্তি আন্তর্জাতিক মহলগুলোর জন্য বসফরাসের দ্বার খুলে দেয়। উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ১৯২৩ সালের লিউসিন চুক্তি, ১৯৩৬ সালের মনট্রিক্স কনভেনশন বসফরাসকে ক্ষমতার মায়াজালে বেঁধে ফেলে। ১৯৭৩ সালে গোল্ডেন হর্ন মোহনায় তৈরি হয় প্রথম সেঁতু “বসফরাস ব্রীজ” যা দুই মহাদেশের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে। পরে এর নাম পালটে রাখা হয় “জুলাই ফিফটিন মার্টিয়া” ব্রীজ। ১৯৮৮ সালে নির্মিত হয় “ফাতিহ সুলতান মেহমেদ ব্রীজ” এবং ২০১৬ সালে “ইয়াভুজ সুলতান সেলিম ব্রীজ”। এছাড়াও ৩৫০ ফুট গভীরে রয়েছে সাড়ে ৫ কিলোমিটারের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত দুই তলা বিশিষ্ট “ইউরোশিয়া টানেল” যার মাধ্যমে এশিয়া থেকে ইউরোপ মহাদেশে ভ্রমণ করতে সময় লাগে মাত্র ১৫ মিনিট। ২০১৩ সালে “মারমারেই টানেল” নামে একটি রেলওয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয় যার জন্য রেয়েছে তিনটি ভূগর্ভস্ত রেল স্টেশন যা ছিল অটোম্যান সুলতানদের স্বপ্ন। রেললাইনটি উদ্ভোধন করতে গিয়ে তুরস্কের বর্তমান এবং ১২তম রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান বলেন, “আজ আমরা বুঝতে পারছি যে, ১৫০ বছর আগে দেখা স্বপ্ন, দুই মহাদেশকে এবং দুই মহাদেশের মানুষদেরকে জোড়া লাগিয়েছে”। বসফরাস প্রণালীর পাড়ে রয়েছে রুমেলি দুর্গ, তোপকাপি প্রাসাদ যা ৪০০ বছর ধরে ব্যবহার হয়ে আসছে(বর্তমানে জাদুঘর এবং ইউনেস্কো ঘোষিত ঐতিহাসিক স্থান), মেইডেন টাওয়ারসহ শত শত ঐতিহাসিক স্থান যা বসফরাসকে উচ্চতার শিখরে নিয়ে গেছে।
বফফরাসের দৈর্ঘ্য ৩০/৩১ কিলোমিটার। সর্বনিম্ন প্রস্থ ২৩০০ ফুট যা যান চলাচলের জন্য বিপজ্জনক। সর্বনিম্ন গভীরতা ৪২ ফুট, সর্বোচ্চ ৩০০ এবং গড় গভীরতা ২১৩ ফুট। ঐতিহাসিকদের মতে, সপ্তদশ শতাব্দীতে সুলতান আহমেদ এবং কোসেম সুলতানার ২য় পুত্র সুলতান চতুর্থ মুরাদের শাসনামলে “হেজারফেন আহ্মেদ চেলেবি” নামক এক ব্যক্তি নিজের দেহের সাথে পাখা লাগিয়ে ইউরোপের গালতা টাওয়ার থেকে বসফরাস প্রনালী অতিক্রম করে প্রায় ২ মাইল দূরে এশিয়া অংশে গিয়ে পৌঁছান যা ছিল প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় মানব উড্ডয়ন। এর পূর্বে সুলতান ২য় উসমানের সময় এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বসফরাস জমে বরফ হয়ে যায়। কয়েকবার এরকম ঘটনা ঘটেছে। বসফরাস শেষবার বরফে আচ্ছাদিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। ১৯৮৯ সালে ৬৪ জন পুরুষ ও ৪ জন নারী প্রতিযোগীকে নিয়ে এখানে শুরু হয় বিখ্যাত মুক্ত পানির সাঁতার প্রতিযোগীতা যা এখনও প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়। এটির আয়োজন করেন তুর্কিশ অলিম্পিক কমিটি এবং স্পন্সর করে স্যামসাং। ২০২১ সালের প্রতিযোগীতাটি হতে চলেছে ২২ আগস্ট। এছাড়া গ্রীক অর্থোডক্স উপাসকরাও যীশুর ব্যাপ্টিজম বার্ষীকি পালনে প্রতি বছর এখানে একবার সাঁতার কাটেন। বিখ্যাত ইস্তাম্বুল ম্যারাথন প্রতিবছর এশিয়া থেকে শুরু হয়ে আয়া সোফিয়ার পাশ দিয়ে ইউরোপ অংশের “সুলতান আহমেদ” নামক একটি জায়গায় গিয়ে শেষ হয়। ১৯৭৯ সালে একদল জার্মান ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে প্রথম শুরু হওয়া এই তিন ক্যাটাগরির ম্যারাথনটি পৃথিবীর একমাত্র আন্তঃমহাদেশীয় ম্যারাথন। তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এ বছর ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৪৩ তম প্রতিযোগিতা। তুর্কি নিউজ পেপার অনুযায়ী এ বছর এরদোগান “ইস্তাম্বুল ক্যানেল” নামে একটি প্রজেক্টের দিকে এগোচ্ছেন যা কৃত্রিমতার মাধ্যমে বসফরাস প্রণালীকে আরও দ্বিগুন করবে। বসফরাস প্রণালীতে রয়েছে স্থায়ী বাসিন্দার মাছ এবং পারিযায়ী মাছ যারা কৃষ্ণসাগর,মর্মর সাগর এবং ভূমধ্যসাগর থেকে আসে। এক অপরুপ সৌন্দর্য, গৌরবময় ইতিহাস আর শত শত নিদর্শনকে দুই পাড়ে রেখে দুই মহাদেশ- এশিয়া ও ইউরোপ, এক দেশ তুরস্ক এবং একটি শহর ইস্তাম্বুলের অবিরাম ভালোবাসার নাম বসফরাস প্রণালী। তাইতো কবি বলেন,
“উজ্জল চকচকে চন্দ্রমরিচীকা ঢেউয়ের উপর নৃত্য করে প্রফুল্লচিত্তে,
গোধূলির মৃদু বাতাসের প্রবাহ ভেদ করে কাঁচের জানালা
হেলান দিয়ে বসে আনন্দে রৌপ্য উজ্জল ঢেউ দেখেন সুলতানা