ডিপ্রেশন বা হতাশা, নামটির সাথে পরিচিত নয় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। যদি ডিপ্রেশন নামের প্রতিশব্দ খুঁজি তাহলে এর বাংলা অর্থ দাড়ায় ‘অবসাদ’। অবসাদ – এই শব্দটির সাথে যে দুঃখ বা বিষাদ লেগে থাকে, সর্বনাশা রোগটিও ঠিক সেইরকমই। যা ডাক্তারী মতে ডিপ্রেশন বলে পরিচিত বা একই অর্থে মনখারাপ আর ভাল না লাগা।
করোনার হিংস্র ভয়াবহতার কারণে দেড় বছরের কাছাকাছি সময় ধরে সব কিছু হয়ে পড়েছে স্থবির। একের পর এক লকডাউন ঘোষণা। বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অফিস-আদালত কিংবা অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও সেক্ষেত্রে মানতে হচ্ছে কঠোর বিধিনিষেধ। এই অবস্থায় অনেকে হারিয়েছে চাকরি কিংবা বন্ধ হয়েছে অনেকের ব্যাবসা-বানিজ্য। সাথে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু পরিবার হয়েছে নিঃস্ব। আর বেকারত্বের সংখ্যা দিন দিন যেন বেড়েই চলছে। এদিকে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকার কারণে বহু কিশোর-কিশোরী বা যুবক এগোচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। আর এর ফলে দিন দিন ডিপ্রেশনের মুখে পড়ছে বহু ছাত্র-ছাত্রি কিংবা বেকার যুবক। এই ডিপ্রেশনের কবলে পড়ে অনেকে হয়ে যাচ্ছে মাদকাসক্ত, কেউ বা বখাটে, কেউ বা করছে আত্মহত্যা।
ডিপ্রেশন বিষয়ে জানতে চাওয়া বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতামত নিচে তুলে ধরা হলো ঃ
বিশ্ববিদ্যালয় যখন খোলা ছিল তখন আমরা নানা কাজে ব্যস্ত থাকতাম। নিয়মিত ক্লাস, পড়ালেখা, খেলাধুলা, সংগঠন সবকিছুতে মেতে থাকতাম। কিন্তু করোনা মহামারীর পরে বিশ্ববিদ্যালয় যখন বন্ধ হয়ে যায় আমাদের নিয়মিত কাজে তখন ব্যাঘাত ঘটে। আমাদের সময় অনেকটা অলস ভাবে কাটে। থাকে না কোন ব্যস্ততা যার কারণে আমরা মাঝেমধ্যেই ডিপ্রেশনে চলে যাই। একজন মানুষ যখন দৈনিক কাজে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখে বা ব্যস্ত রাখে সে কখনো ডিপ্রেশনে যেতে পারবেনা বলে আমার মনে হয়। অনেক সময় অনাকাঙ্ক্ষিত কারণবশত কারণেও ডিপ্রেশনে চলে যাই।আবার আমার ভালো লাগার বিষয় হলো ট্রাভেলিং। এই করোনা মহামারীর কারণে আমি ঘুরতে পারছি না কিংবা আমার ভালো লাগার বিষয়গুলো পূরণ করতে পারছিনা। যার কারনে মাঝে মধ্যেই ডিপ্রেশনে চলে যাই। আবার যখন কিছুদিন পরে একটা ভাল ট্যুর দিতে পারি তখন এই ডিপ্রেশন সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারি।
এতো বছর পড়াশোনা করার পরও যখন বুঝতে পারি আমাদের ভবিষ্যৎ এর কোন নিশ্চয়তা নাই।এটা একটা কারণ। তাছাড়া আমাদের ভবিষ্যৎ এখন কিসের ওপর ডিপেন্ড করে তাও জানিনা। যদি মিডেল ক্লাস পরিবারের কথা বলি, আমরা যারা লেখাপড়া করছি, আমরা না পারছি লেখাপড়ায় মনোযোগে হতে না পারছি পরিবারকে আর্থিক একটা সাপোর্ট দিতে। সবকিছু মিলিয়ে ভাবতে গেলে ডিপ্রেশনের কবলে পড়ে যাই।
ঘুম হয় না অনেক চিন্তায়। সেশন জট, হুটহাট পরিক্ষা, পরিবারের সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, চারপাশের মানুষের সাফল্য কিন্তু নিজে এখনো কিছু করতে পারছি না। সারাবছর বাংলা মিডিয়ামে পড়াশুনা করে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সব পড়ালেখা করতে হচ্ছে ফুল ইংলিশে। সবকিছু মিলিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা হয়। করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে বাসায় থেকে পড়াশুনা করতে এবং পরিক্ষা দিতে। অনেক শিক্ষক রয়েছে যারা শিক্ষার্থীদের সমস্যা বুঝে না আর তারা প্রোপার হেল্পফুল না। এসব বিষয় অনেক ভাবায়। আর ছোটবেলায় পরিবারের অনেক সমস্যা বুঝতাম না। এখন বড় হইছি এবং আস্তে আস্তে অনেক বিষয় নিয়ে চিন্তা হচ্ছে আর মাঝে মাঝেই ডিপ্রেশনে পড়ে যাই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র দেওয়া নিয়মাবলী (গাইডলাইন) অনুযায়ী, অবসন্ন মন (‘লো মুড’), শক্তিহীনতা (‘লো এনার্জী’) এবং উৎসাহহীনতা (‘লো ইন্টারেস্ট’)-কে ডিপ্রেশনের আওতায় ফেলা হয়েছে। আরেকটু গভীরে ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে দেখতে পাই, বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী অ্যারন বেক-এর তত্ত্ব অনুযায়ী, নিজের, পরিবেশের এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা (নেগেটিভ ভিউ)-র সম্মিলিত প্রকাশই হল ডিপ্রেশন। যদিও, শুধু নেতিবাচক ধারণা থাকলেই চলবে না, রোজকার জীবনে তার প্রভাবও পড়া চাই। বই-এর ভাষায় যাকে বলে – ‘Significant Socio-occupational impairment’।
ডিপ্রেশন অবস্থায় থাকা মানুষের মাঝে বেশ কিছু লক্ষণ প্রতিফলিত হয়। এর মদ্ধে অন্যতম,
★পছন্দের কাজকেও, অপছন্দ মনে হওয়া।
★ খাবারের প্রতি অনিচ্ছা দেখা দেয়।
★ঘুম কমে যাওয়া বা অতিরিক্ত ঘুমোনো।
★লস অফ এনার্জি দেখা দেওয়া
★এর সঙ্গেই অহেতুক অপরাধবোধ দেখা দেবে। নিজেকে সব ব্যাপারে দোষী ভাবতে শুরু করবেন।
★সব বিষয়ে মনোযোগও কমতে থাকবে। একটানা কোনও কাজ করতে পারবেন না।
★আর মুভমেন্ট কমবে বা অতিরিক্ত বাড়বে। হতে পারে, কেউ সারা দিন একটা ঘরে শুয়েই থাকলেন। আবার হতে পারে কেউ চিন্তা করতে করতে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে পায়চারি করে গেলেন।
★সারা দিনের কাজের পরিকল্পনা বা কোন কাজকে প্রাধান্য দেবেন, তা-ও নির্ধারণ করতে পারবেন না।
★আত্মহত্যা করার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। খুব কম ক্ষেত্রে হলেও কিছু ঘটনা দেখা গিয়েছে যে, নিজের উপরে নির্ভরশীলদেরও মেরে ফেলার কথা ভাবতে পারেন।
তবে বেশ কিছু উপায় অবলম্বন করলে ডিপ্রেশন থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। তার মদ্ধে অন্যতম –
★লক্ষ রাখতে হবে সব সময় যেন নৈতিকতার মাধ্যমে আনন্দে থাকা যায়।
★সুখ-দুঃখ টাকার এপিঠ আর ওপিঠ। দুটোকে মেনে নিতে হবে
★যেখানে খুশি হারিয়ে যায় সেখান থেকে খুশির পথ খুঁজে নিতে হয়।
★চিন্তার পরিবর্তন দরকার। বিষাক্ত চিন্তা, ব্যর্থ চিন্তা, নেতিবাচক চিন্তা, অহেতুক চিন্তা, ভয়ের চিন্তা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকার ব্যবস্থা নিতে হবে। তার জন্য ম্যানেজমেন্টের কথা হলো, কথা বলো, শান্ত থাক, ইতিবাচক হও, অন্যকে নয় নিজেকে বদলাও।
★আমাদের মধ্যে যেমন অনেক গুণ আছে তেমনি আবার ত্রুটিও আছে। ত্রুটিগুলোকে স্মরণ করা ও কাজে লাগানো দরকার।
★নিজের কাউন্সেলিং নিজে করা দরকার। বিশেষ করে রাতে শোয়ার আগে, সারা দিনের অ্যাকাউন্ট চেক করা এবং পরের দিন পুনরাবৃত্তি যেন না হয় তার প্রতি লক্ষ্য রেখে নতুনভাবে শুরু করা দরকার।
★মনের প্রভু তো আমি। মন আমার দাস। তাই মনকে দমন নয় বরং সুমনে পরিবর্তন করা দরকার। চাবকে নয়, ভালোবেসে করা দরকার।
★কেউ আমাকে বিরক্ত করলে কেন বিরক্ত হব? আমি পারমিশন দিচ্ছি কেন? কারণ মন দুর্বল তাই। মনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা দরকার।
★আমি যা আমি তাই। মেনে নিতে হয়। লক্ষ্য মহৎ হলে সফলতা আসবেই। ধৈর্য ও সহনশীলতার কবচ সঙ্গে থাকলে জয় হবেই হবে। এক্সপেক্ট ও রিজেন্ট এই অঙ্ক জানা থাকলে ডিপ্রেশন আসবে না।
★তরুণ-তরুণীরা মাথাকে যত ব্যবহার করবে ততই ভালো থাকবে।
★যত সিম্পল হওয়া যাবে ততই ডিপ্রেশন মুক্ত থাকা যাবে। অসম্ভব কথাটা আমাদের অভিধানে থাকতে নেই।
★নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে সঙ্গে নিয়ে চললে ডিপ্রেশনকে প্রতিহত করা যাবে।
★ভুলে যাও, ক্ষমা করো এই দুটো শব্দ ডিপ্রেশন মুক্ত জীবনের চাবিকাঠি।
★সব বোঝা আল্লাহকে সমর্পণ করে দিয়ে মুক্ত মনে থাকতে পারলে ডিপ্রেশন আসবে না।
★বাহ্যিক সুখ ক্ষণস্থায়ী, সেই জন্য এই সুখে লালায়িত না-হয়ে আন্তরিক সুখের সন্ধানে নিয়োজিত থাকা দরকার।
★হীনতাকে সহযোগী করা উচিত নয়।
★তর্কে তর্ক বাড়ায় সেই জন্য প্রয়োজনে হার স্বীকার করা ভালো। এই হার হার নয়, হরমনি সৃষ্টি করে।
★রোগ আসবে কিন্তু রোগী হওয়া ঠিক নয়। রোগ দেহের হয়, চিকিৎসা করা দরকার কিন্তু মন যেন রোগাক্রান্ত না হয়ে যায়।
★ক্রোধকে অস্ত্ররূপে ব্যবহার করা দুর্বলতার লক্ষণ। দুর্বল নয়, সবল হওয়া দরকার। ক্রোধ আসলে বিরাম নেওয়া দরকার। তিন-চারবার গভীর শ্বাস নিলে ক্রোধ কমে যাবে।
★শুভ ভাবনার এনার্জি বিকিরণ করা দরকার।
★নিজের পছন্দমতো সবকিছু সব সময় হবে আশা করা বৃথা। সেই জন্য পছন্দমতো যদি না হয়, তাহলে ইগোকে ব্রেক করে সবকিছুকে মেনে নেওয়া দরকার।
★শ্রদ্ধা এক ধরনের ইতিবাচক এনার্জি। সবার জন্য সমান হওয়া দরকার সে ছোট হোক আর বড়।
★মা-বাবারা কীভাবে সন্তানকে ডিপ্রেশন থেকে মুক্ত রাখবেন তার জন্য নিজে নিজেই চেষ্টা করা দরকার। সেই চেষ্টা করতে কার্পণ্য করা উচিত হবে না।
★বহির্জগৎ, টিভি, ইন্টারনেট, সেল ফোন ডিপ্রেশন সৃষ্টি করে সেই জন্য নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এসবের ব্যবহার করা উচিত। অন্যথায় জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
ওষুধ, কাউন্সেলিং, যোগাসন, সহজ রাজযোগ, মেডিটেশন করা দরকার। এতে করে আবার সুস্থ জীবন ফিরে পাওয়া যাবে।